Thursday, October 31, 2024

নতুন সংবিধান বিতর্ক: ১৯৭২ এর সংবিধানের “ত্রুটি”





ড. এম জসিম আলী চৌধুরী 
প্রভাষক আইন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব হাল, যুক্তরাজ্য 

সিফাত তাসনীম
আইন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি



৫ অগাস্টের পর হতে এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, সভা-সেমিনার, টক শো-তে ১৯৭২ এর সংবিধান বাতিলের পক্ষে যত যুক্তি এসেছে সেগুলো সবগুলোকে আমরা এক জায়গায় করার চেষ্টা করেছি। যুক্তিগুলো মোটামুটি দুই দাগের। একদিকে ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার বেশ কিছু “গলদ” এর কথা বলা হচ্ছে। অন্যদিকে ১৯৭২ এর সংবিধানের বিভিন্ন বিধানের সুনির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট অনেক “ত্রুটি”র কথা বলা হচ্ছে। তিন পর্বের এ লেখার প্রথম পর্বে আমরা সংবিধান প্রণয়নের “গলদ” যেগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে সেগুলো বিবেচনা করেছি। এ পর্বে আমরা ত্রুটিগুলো উপস্থাপন করে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। পরের পর্বে তুলে ধরবো কেন নতুন সংবিধানের ধারণাটি দেশের ভালোর চেয়ে ক্ষতি বেশি করবে।


১৯৭২ এর সংবিধানের বিভিন্ন বিধানের মোটামুটি ছয়টি “ত্রুটি” ধরা হয়েছে। এর কতগুলো আদর্শিক, কতগুলো ঢালাও এবং কতগুলো সুনির্দিষ্ট।

প্রথম যুক্তিটি একেবারে রাজনৈতিক এবং অনেকটা ঢালাও। বলা হচ্ছে “মুজিব বাদ” তথা ১৯৭২ এর সংবিধান ফ্যাসিবাদের আঁতুড় ঘর। ওই সংবিধান সংশোধন করে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঠেকানো যাবে না।

আমরা মনে করি এ যুক্তিটিতে ১৯৭২ এর সংবিধানের চার মূলনীতির প্রতি এক ধরণের বিতৃষ্ণা প্রকাশ পায়। আমরা আত্নবিশ্বাসের সাথে দাবী করি যে, ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরতন্ত্র “মুজিব বাদ”, সংবিধানের চার নীতি বা এগুলোর পরিবর্তিত কোন ভার্সন থেকে আসে না। ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরতন্ত্র আসে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার সংকট ও রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার গোঁড়ার গলদ থেকে। ফ্যাসিবাদের উত্থান ঠেকাতে হলে আমাদেরকে সাংবিধানিক কাঠামো ও দল ব্যবস্থার দিকে নজর দিতেহবে।

“মুজিব বাদ” প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য হলো, বাংলাদেশের সাংবিধানিক জুরিস্প্রুডেন্সে “মুজিব বাদ” নামের কোন ডক্ট্রিন পাওয়া যায় না। এটি সত্য যে, ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়নের সময় বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা সংবিধানের চার নীতিকে “মুজিব বাদ” হিসেবে তুলে ধরতেন। কিন্তু ১৯৭৫ এর চতুর্থ সংশোধনীতেই এই রাজনৈতিক শ্লোগানের মৃত্যু ঘটে। ১৯৮০-র দশকে রাজনীতিতে ফিরে আসার পর হতে আজ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে “মুজিব বাদ” শব্দটিকে মহিমান্বিত করা বা এমন কি এটাকে তাঁদের সিগনেচার রাজনৈতিক ডক্ট্রিন হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়নি। আমাদের সুপ্রিম কোর্টের ৫৩ বছরের জুরিস্প্রুডেন্স দেখলে দেখা যাবে, সেখানে নানা সময় “মুজিব বাদ” নয়, “সংবিধানের চার মুল নীতি”র কথা এসেছে। প্রশ্ন করা যেতে পারে, মুল সংবিধানের চার নীতিই আমাদের সব সমস্যার কারণ কিনা।

চার নীতির প্রথমটি, গণতন্ত্র, নিয়ে কারো প্রশ্ন নেই। দেশের সামরিক বা রাজনৈতিক, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি বা বিএনপি – কোন সরকারের আমলের কোন সংশোধনীতে এ নীতিটির উপর হাত দেয়া হয় নি। বিএনপি-র আমলে দ্বিতীয় মুল নীতি, সমাজতন্ত্র,-র সংজ্ঞা সীমিত করা হয়েছিলো। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সংজ্ঞাটাকে আগের জায়গায় নিয়ে গেলেও পশ্চিমা লিবারেল ধাঁচের ব্যক্তি মালিকানা ও মুক্তবাজার অর্থনীতির উপর দুই দলেরই অঘোষিত ঐকমত্য হয়ে গেছে। ১৯৭৫ এর পর হতেই বাংলাদেশ আর সমাজতান্ত্রিক দেশ নয়।

বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ বা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক থাকলেও ২০১১ সালের ১৫ সংশোধনীতে এসে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশী নাগরিকত্বের বাস্তবতাটি মেনে নিয়েছে। তাঁরা ১৯৭২ এর মুল সংবিধানের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে ফিরেনি। ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক চালু আছে। কিন্তু এখানেও দেখা যাবে, ২০১১ সালের ১৫তম সংশোধনীতে আওয়ামী লীগ ধর্ম নিরপেক্ষতার যে সংজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা করেছে, সেটি ১৯৭২ সালের সংজ্ঞার চেয়ে ভিন্ন। তাঁরা রাষ্ট্র ধর্ম, আল্লাহ্‌র উপর আস্থা বিশ্বাস, বিসমিল্লাহ, ইত্যাদি রেখে দিয়েছেন। ১৯৭২ এর মতো করে ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে সরাসরি নিষিদ্ধ বলেননি। এক ধরণের সমঝোতা ও পরিবর্তিত সময়ের বুঝ সেখানে স্পষ্ট।

এমতাবস্থায়, “মুজিব বাদ” এর মতো অতীতমুখী ধারণাকে সামনে এনে, ১৯৭২ এর সংবিধান ছুঁড়ে ফেলার যুক্তিটি অনেকটাই “র‍্যাডিক্যাল” ও অপ্রয়োজনীয় বিবেচিত হতে পারে। রাজনৈতিক আদর্শনিয়েতর্ক-বিতর্কএকটি চির চলমান প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক দলগুলো সময়ের সাথে সাথে একে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের দেশে এগুলো নিয়ে একসময় মাত্রা অতিরিক্ত ঝগড়া বিবাদ হয়েছে। ১৫-তম সংশোধনী পর্যন্ত আসতে আসতে দেখা যাচ্ছে, বিবাদের উত্তাপ অনেকটাই স্থিমিত।এসময় নতুন করে পুরোনো বিবাদ উস্কে দিলে বরং জাতীয় ঐক্য অর্জন পরাহতই হবে। আদর্শিক বিরোধকে উস্কে দিয়ে বা অপছন্দের আদর্শকে সমূলে উৎখাত করার চেষ্টা পৃথিবীর ইতিহাসে কখনোই সফল হয়নি। এ ধরণের চেষ্টা থেকেই বরং ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থানের আশংকা বেড়ে যায়।

দ্বিতীয় যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে ১৯৭২ এর সংবিধানে মৌলিক অধিকারের তালিকা আছে কিন্তু বাস্তবায়নের কোন পথনির্দেশ নেই যে কারণে ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট এর মতো কালো আইন হয়েছে।

আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানে আমরা দুনিয়ার বুকে এমন কোন সংবিধান পাইনি যেখানে মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের একশো’টা পথ বাতলে দেয়া হয়েছে। ১৯৭২ এর সংবিধানের ২৬, ৪৪ এবং ১০২ অনুচ্ছেদে বরং মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের বেশ শক্তপোক্ত পথ নির্দেশ করা আছে। এ অনুচ্ছেদগুলোর মাধ্যমে অহরহ মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন চ্যালেঞ্জ হয়েছে, বাতিল হয়েছে – ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, জননিরাপত্তা আইন তার কয়েকটা উদাহরণ। বিশেষ ক্ষমতা আইন, আইসিটি এক্ট, ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট, দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল আইনসহ অনেক আইন চ্যালেঞ্জ হয়নি অথবা এগুলোর অপপ্রয়োগ রোধে ফৌজদারি আদালত ব্যবস্থা ভূমিকা রাখতে পারেনি।

সেটার দোষ কার? রাজনৈতিক সরকারের, তাদের কুক্ষিগত করে রাখা আদালতের এবং তাঁদের অনুগত আইনজীবী সমাজের? নাকি ১৯৭২-এর সংবিধানের? সমস্যাটা কি এই সংবিধানের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে? নাকি অধস্তন আদালতকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার জন্য মূল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে দেয়া নির্দেশনা উপেক্ষা করার মধ্যে? তাছাড়া প্রস্তাবিত নতুন সংবিধানে মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের জন্য কি কি নতুন ব্যবস্থা থাকবে তার কোন ইঙ্গিতও পরিষ্কার নয়।

হতে পারে দেশে সাংবিধানিক আদালত ব্যবস্থা চালু হলো, অথবা সংসদে আইন প্রস্তাব আসার সময়ই এটাকে সুপ্রিমকোর্টের জুডিশিয়াল রিভিউ-র আওতায় আনার ব্যবস্থা আসলো (যেটি শ্রীলংকায় আছে)। কিন্তু এগুলোর কোনটার জন্যই ১৯৭২ এর মুল সংবিধান বাতিল করার দরকার নেই। সংশোধন করলেই চলে। অবশ্য সাংবিধানিক আদালত বা প্রি-লেজিসলেটিভ জুডিশিয়াল রিভিউও কাজ করবে না যদি প্রতিষ্ঠানগুলো চিরাচরিত নিয়মে দলীয়করণ হতে থাকে। সুতরাং সমস্যাটা ১৯৭২ এর সংবিধানের নয়। সমস্যাটা সংবিধান যারা মানে বা ছুঁড়ে ফেলে দেয় তাঁদের।

তৃতীয় যুক্তি হিসেবেও অনেকটা পাইকারি একটা কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আমাদের দেশে জনগণের ক্ষমতায়ন নেই। মাঝে মাঝে একটি নির্বাচন হলেও, নির্বাচনে ভোট দেয়া (যদি আদৌ দেয়া যায়) ছাড়া রাষ্ট্র ক্ষমতায় জনগণের অংশগ্রহণের কোন রাস্তা থাকে না।ফলে জনগণকে সংঘাতপূর্ণ বিপ্লব বা অভুথ্যান এর পথ বেছে নিতে হয়।

আমরা ঠিক নিশ্চিত নই এ যুক্তিতে ১৯৭২ এর সংবিধান বাতিল হয় কিভাবে। ১৯৭২ এর সংবিধানে নির্বাচন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কাঠামোটি ঠিক করে দেয়া হয়েছে। এর সাথে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো যোগ করা হয়েছে। ব্যবস্থাটি “অগণতান্ত্রিক” অজুহাতে বাতিল করে দেয়া হলেও, ওই বাতিল করাটাই বরং অগণতান্ত্রিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদালতের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবনের সুযোগ আছে। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা বেশ স্পষ্টভাবেই সংবিধানে আছে।কিন্তু প্রয়োগ হয়না। নানা নির্বাচনী আইনও সংস্কার করার সুযোগ আছে।

এর বাইরে, অংশগ্রহণমূলক সরকার বা জনপ্রশাসন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা অভ্যাসের ব্যাপার। যেমন, ১৯৭২ এর সংবিধানে জাতীয় সংসদকে জনগণের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবেই দেখা হয়েছে। সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে ও সংসদীয় কমিটিগুলোর কার্যক্রমে জনসম্পৃক্ততার ভালো সুযোগ রাখা হয়েছে। চর্চাটা রাজনৈতিক সরকারগুলো করছে না, সেটি ১৯৭২ এর সংবিধানের ত্রুটি নয়। ১৯৭২ এর সংবিধানের কোথাও জনগণের অংশগ্রহণমূলক সরকার ব্যবস্থার কথা কম বলা হলে সেটি সংশোধন করে আরো বেশি কিছু বলা যায় কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু এটিকে বাতিল করে নতুন আরেক সংবিধান নেয়া হলে সেটিই রাজনৈতিক দলগুলো অক্ষরে অক্ষরে মানতে শুরু করবেন এই অলীক কল্পনারই বা ভিত্তি কি?

চতুর্থ যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে ১৯৭২ এর সংবিধানের “অনেক ত্রুটি”। এটি এত বেশি কাটাছেঁড়া হয়েছে যে, এক দুই জায়গায় সংশোধন করে এটি ঠিক করা যাবে না। তার চেয়ে নতুন করে লিখাটাই ভালো।

বর্তমানে দেশে সংবিধান নিয়ে যেসব সভা-সেমিনার বা আলাপ-আলোচনা হচ্ছে সেখানে ঢালাও কথা এবং তাত্ত্বিক কথা বেশি বলা হচ্ছে। সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে বলা হচ্ছে না কোথায় কি করা দরকার। যদি দেখা যায় নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় সংশোধন করলেই হয় তাহলে সংবিধান সংশোধনই যথেষ্ট। আর যদি দেখা যায় সমস্যা একেবারে “সীমাহীন” তাহলে হয়তো বলা যাবে মূল সংবিধানটার “সবকিছুই” একেবারে অকেজো হয়ে গেছে। সুতরাং নতুন দরকার পড়ছে।

এক্ষেত্রে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ৩১-দফা “রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাব” আমরা পড়েছি। তাঁরা কিছু বিষয় একেবারে নির্দিষ্ট করেছেন। যেমন – প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুইবারের বেশি না, দুইকক্ষের সংসদ প্রতিষ্ঠা, ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে আমেরিকার মতো সংসদীয় কমিটির সামনে শুনানী, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ (এটির জন্য মুল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবন করলেই হয়), বিচারক নিয়োগ ও অপসারণে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন (এটিও মুল সংবিধানে বলা আছে) এবংস্থানীয় সরকারে হস্তক্ষেপ না করা (এটিও মুল সংবিধানেআছে)।আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিএনপি-র সবগুলো দফা একসাথে একবারে বাস্তবায় নকরতে গেলেও সংবিধান “নতুন করে লেখার” দরকার নেই। চিহ্নিত জায়গাগুলোতে সংস্কার করলেই চলে। বিএনপি-র পক্ষ থেকেও নতুন সংবিধানের কোন দাবী নেই। তারা বরং সংস্কারের কাজটিও নির্বাচিত সরকারের করা উচিত বলে মনে করেন।

পঞ্চম যুক্তিটি এখন পর্যন্ত যত যুক্তি দেয়া হয়েছে, তার ভেতর সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত এবং শক্ত যুক্তি। ১৯৭২ এর সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, ফলে রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামো ভারসাম্যহীন হয়ে গেছে।

আমরা এই যুক্তির বাস্তবতা উপলব্দি করি। ১৯৭২ এর সংবিধানের একটি বড় সমালোচনা হচ্ছে যে সংবিধান প্রণেতারা সংসদীয় ব্যবস্থার ভেতর সরকার প্রধানের ক্ষমতা বেশি দিয়েছেন। তবে গভীর বিবেচনায় এ সমালোচনাটিকে কিছুটা অপরিপক্ব বলে মনে হয়।১৯৭০ সালের এক পাবলিক লেকচারে লর্ড হেইলসাম ব্রিটিশ ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থাকে ‘প্রধানমন্ত্রীর স্বৈরতন্ত্র’ (Prime Ministerial Dictatorship) আখ্যা দিয়েছিলেন। ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থাটি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে স্বীকার করেই সাজানো। এ ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর উপর নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিতা আসে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, সংসদের বিরোধীদল, শক্তিশালী ও স্বতন্ত্র স্থানীয় সরকার, স্বাধীন বিচার বিভাগ, শক্তিশালী গণমাধ্যম ও জবাবদিহি নিশ্চিতকারী অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে।আমাদের মতো উপনিবেশ-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোতে জবাবদিহির এই বিকল্প রাস্তাগুলো বন্ধ থাকায় বা শক্তিশালী না হওয়ায় ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থার প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রিকতাটিকে অতিরিক্ত চোখে পড়ে।

তারপরও আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে কমাতে হলে কি করা যায়? এ প্রশ্নের উত্তরে নানা সময়ে দেখা গেছে সবাই রাষ্ট্ৰপতির ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেন। এখানে সমস্যা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতির সাথে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার সঙ্ঘাতের বিপদজনক নজির আমাদের আছে। অবিভক্ত পাকিস্তানে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ এর সাথে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, ফিরোজ খান নুন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির বিরোধে পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোই ভেঙ্গে পড়ে। ১৯৯০ এর দশকে পাকিস্তানে গোলাম ইসহাক খানের সাথে বেনজির ভুট্টো এবং ফারুক লেঘারির সাথে নওয়াজ শরীফ ও বেনজির ভুট্টোর সংঘাতে দেশটিমারাত্নক সাংবিধানিক সংকটে পড়ে যায়। ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার সাথে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমা সিংহের বিরোধে শ্রীলঙ্কাও খাঁদের কিনারে পৌঁছে যায়। এসব বিবেচনায় আমাদের দেশের সংস্কারগুলো সংসদীয় ব্যবস্থারমুল কাঠামো ঠিক রেখে করাটাই সঙ্গত।


কেউ দুই বারের বেশী প্রধানমন্ত্রীহতে না পারার প্রস্তাব আছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণ। আমাদের সরকারগুলো প্রতিষ্ঠান বা সংবিধানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়ার চেয়ে ব্যক্তি বা দলীয় প্রধান কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।১৯৭২ এর সংবিধানে রাজনৈতিক দলগুলোকে একেবারে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কেউ দুই বারের বেশী রাজনৈতিক দলের প্রধান হতে না পারার শর্ত থাকা উচিৎ। অন্যথায় পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা প্রধানমন্ত্রী না হয়েও সরকার চালাতে পারবেন। তাঁদের কথার বাইরে যাওয়া প্রধানমন্ত্রীকে দলীয় এমপি দিয়ে বিদ্রোহ করিয়ে ফেলে দিতে পারবেন। রাষ্ট্রপতি পদে কেউ দুই বারের বেশী না হওয়ার বিধানটাও রাখতে হবে। অন্যথায় হয়তো, প্রধানমন্ত্রী হতে না পারা নেতারা রাষ্ট্রপতি হয়ে ক্ষমতার কলকাঠি নাড়বেন। দলের ভেতরে নেতৃত্ব নির্বাচনটা দল প্রধানের বা পরিবারের ইচ্ছেয় না হয়ে, অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার গোপন ব্যালটে নির্বাচিত হওয়ার শর্ত থাকতে পারে। এ সবের কোন কিছুর জন্যই আমাদের একটি নতুন সংবিধানের দরকার নেই।

ষষ্ঠ যুক্তিটি বেশ জনপ্রিয়। বলা হয় সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ গণতন্ত্র বিরোধী এবং এটিই সব সমস্যার মুলে।

বাংলাদেশের প্রায় সবাই আমাদের সব সমস্যার জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদকে দায়ী করেন। সংবিধান প্রণেতারা সরকারের স্থিতিশীলতা রক্ষায় এর প্রয়োজনের কথা বলেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোও বিগত ৫৩ বছরে এ বিধানটি বাতিল করেন নি। ধারণা করা যায়, তাঁরাও সংবিধান প্রণেতাদের সাথে একমত।

এখন কেউ কেউ বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে সরকারের উপর অনাস্থা প্রস্তাবের ভোটাভুটিতে ৭০ অনুচ্ছেদ দরকার হলেও বাজেট ভোটাভুটিতে ৭০ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ হবে না এমন বিধান করা যেতে পারে। আমরা মনে করি এটির সমাধান এখানে নয়। কারণ সংসদের বিরোধিতায় কোনো সরকার বাজেট পাস করাতে ব্যর্থ হলেও সরকার পতন বা সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার অবস্থা তৈরি হতে পারে। তাছাড়া বাজেটে সরকারের বিরদ্ধে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা থাকলেই এমপি-রা ভোট দেবেন এমন নিশ্চয়তা নেই। ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদের প্রশ্নোত্তর, সংসদীয় বিতর্ক বা সংসদীয় কমিটির কার্যক্রমে প্রযোজ্য নয়। অথচ দেখা যায়, সেখানেও দলের এমপি-রা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন না। গণতন্ত্রবিহীন এবং ব্যক্তিগত আনুগত্যভিত্তিক রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার কারণে এসব জায়গায় ৭০ অনুচ্ছেদ না থেকেও আছে। কারণ সংসদ সদস্যদের পক্ষে দলের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরোধিতা করা বা সরকারের নীতির বিরোধিতা করা অনেকটাই রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ১৯৭২ এর সংবিধান বাতিল করে আরেকটি সংবিধান লিখে ফেললেই, এবং সেটাতে ৭০ অনুচ্ছেদ থাকলে বা না থাকলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যাটি আমাদের রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার ভেতরে, যেখানে গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, তৃণমূলের পছন্দে দলের মনোনয়ন লাভ বা নেতৃত্বের স্থানে উঠে আসার সুযোগ অনুপস্থিত। সংস্কারের প্রশ্ন আসলে এখানেই আসা উচিত।

পরের পর্বের আলোচনায় আমরা দেখাতে চেষ্টা করবো কেন নতুন সংবিধানের ধারণাটি আত্মঘাতী হতে পারে।

Wednesday, October 30, 2024

নতুন সংবিধান বিতর্ক: ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়নের ‘গলদ’



ড. এম জসিম আলী চৌধুরী
প্রভাষক আইন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব হাল, যুক্তরাজ্য

সিফাত তাসনীম
আইন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি।

অনলাইন লিংক - লইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ, ২৯ অক্টোবর ২০২৪ 



১৯৭১ সালের মহানমুক্তি যুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের লেখা সংবিধানটি পুরোপুরি বাতিল করে দেয়া হবে নাকি সংশোধন করা হবে সেটি নিয়ে দেশে তুমুল বিতর্ক চলছে। যারা মুল সংবিধান বাতিল করতে চান তাঁদের এক ধরনের রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ও ঝোঁক আছে। মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭১ ও সংবিধানের মুলনীতিগুলো নিয়ে নিজ স্বদৃষ্টিভঙ্গি আছে। তাঁদের নানামুখী তৎপরতায় মুল সংবিধান বাতিলের পক্ষে যুক্তি ও ন্যারেটিভ তৈরির কাজ চলছে।

তার বিপরীতে বিপক্ষের বক্তব্যগুলো খুব বেশি উচ্চারিত হচ্ছে না। আমরা মনে করি সংবিধানের মতো এত বড় বিতর্কে দুই দিকের কণ্ঠই জোরালোভাবে উচ্চারিত হওয়া অত্যন্ত জরুরী। বুদ্ধিভিত্তিক সততার স্বার্থে আমরা এই নিবন্ধের লেখকদ্বয় প্রথমেই স্বীকার করে নিই যে, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭২ সালের মুল সংবিধান এর প্রতি আমাদের আদর্শিক পক্ষপাত এবং গভীর অনুরাগ আছে। ওই অবস্থান থেকেই আমরা চলমান বিতর্কে অংশ নিতে চাই। তবে নিশ্চিত করতে পারি যে, আমাদের আলোচনায় অনুরাগ-আবেগের উপর যুক্তি প্রাধান্য পাবে।


৫ অগাস্টের পর হতে এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, সভা-সেমিনার, টকশো-তে ১৯৭২ এর সংবিধান বাতিলের পক্ষে যত যুক্তি এসেছে সেগুলো সবগুলোকে আমরা এক জায়গায় করার চেষ্টা করেছি। যুক্তিগুলো মোটামুটি দুই দাগের। একদিকে ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার বেশকিছু “গলদ” এর কথা বলা হচ্ছে। অন্যদিকে ১৯৭২ এর সংবিধানের বিভিন্ন বিধানের সুনির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট অনেক “ত্রুটি”র কথা বলা হচ্ছে। তিন পর্বের এ লেখার এই প্রথম পর্বটিতে আমরা সংবিধান প্রণয়নের “গলদ”যেগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে সেগুলো বিবেচনা করবো। দ্বিতীয়টিতে আমরা এর “ত্রুটি”গুলো আলোচনা করার চেষ্টা করবো। তৃতীয়টিতে আমরা তুলে ধরবো কেন নতুন সংবিধানের ধারণাটি দেশের ভালোর চেয়ে ক্ষতি বেশি করবে।

পত্রপত্রিকা ঘেঁটে এযাবৎ আমরা ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়নের “গলদ” সংক্রান্ত মোটামুটি চারটি যুক্তি খুঁজে পেয়েছি।

প্রথম যুক্তিটি এ রকম – ১৯৭২এর গণ পরিষদের সংবিধান প্রনয়ণের এখতিয়ার প্ৰশ্নবিদ্ধ। ১৯৭০ এ আওয়ামী লীগের নিরংকুশ জয়টা ছিলো পাকিস্তানের নির্বাচনের বিজয়। ওটা দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান লেখা যায় না। তাছাড়া ওই সময় সংবিধানের উপর কোন রেফারেন্ডাম নেয়া হয়নি।

ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে ১৯৭০ এর নির্বাচন কেবল একটি নিয়মিত সংসদীয় নির্বাচন ছিলো না। নির্বাচনটি একটি সুষ্পষ্ট সাংবিধানিক বিতর্কের উপর হয়েছে। ১৯৬৬-র ছয়দফা শুধু প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী ছিলোনা।এতে সংসদীয় গণতন্ত্র এবং বেসামরিক শাসনের রূপরেখাও ছিলো। ছয়দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার দাবীতে সারাদেশে পাঁচ বছরব্যাপী তুমুল রাজনৈতিক অনুশীলন হয়েছে। ১৯৭০ এর মেনিফেস্টোই ছিল ছয় দফা।

নির্বাচনের পর জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক শাসকগোষ্ঠী মূলত ছয় দফা-র ভিত্তিতে সংবিধান রচনায় আপত্তি জানিয়েই যুদ্ধ চাপিয়ে দেন। নির্বাচনে বিজয়ী দলের এমপি-রা ছয় দফা ভিত্তিক সংবিধানের প্রতিশ্রুতির উপর অটল থাকার লক্ষ্যে ১৯৭১ এর জানুয়ারিতে রেসকোর্স ময়দানে গণ শপথ করেন।

এরপর ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে স্বাধীনতার যেঘোষণাপত্র দেয়া হয় সেটিও একটি সাংবিধানিক দলিল। যুদ্ধশেষ হওয়ার সাথে সাথে ১৯৭২ এর জানুয়ারি মাসের অন্তর্বর্তী সংবিধানও ছিলো একটি সাংবিধানিক রূপরেখা। সংবিধান প্রণেতাদের ১৯৭০ নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয়ের পর ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে ১৯৭২ সালে কোন রেফারেন্ডাম হলে সেটিতে সংবিধান প্রণেতারা অনায়াসেই জিততেন। এতে কিছুটা সময় লাগা ছাড়া, অদৌ ভিন্ন কোন ফলাফল কি আসতো?

ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত সংবিধান বিশারদ ব্রুস আকারম্যান বলেন, সংবিধান রচনা বা বড়সড় পরিবর্তনের কন্সটিটিউশনাল মোমেন্ট (Constitutional Moment) আসার জন্য দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও এজেন্ডা থাকতে হয়।

এ প্রেক্ষিতে আমরা অত্যন্ত আস্থার সাথে দাবী করি যে, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ একটি কন্সটিটিউশনাল মোমেন্ট ছিলো, যেটির জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক বিতর্ক, এজেন্ডা এবং রূপরেখা অবিভক্ত পাকিস্তানের ২৪ বছর সময়কাল ধরে তৈরি হয়েছে। বিপরীতে বর্তমানে যে সংবিধান লেখার কথা বলা হচ্ছে সেটির রূপরেখা বা এজেন্ডা পরিস্কার নয়।এমনকি দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোও এ ব্যাপারে সম্যক অবহিত নন।

সংবিধানের সংস্কার হবে নাকি পুনর্লিখন হবে সেটি নিয়েও জাতীয় ঐকমত্য এখনো স্পষ্ট নয়।

দ্বিতীয় যুক্তিটি এরকম – ১৯৭২ এর সংবিধান আইয়ুব-ইয়াহিয়ার পাকিস্তানী শাসন কাঠামোর উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে।

আমরা মনে করি এ বক্তব্যটি অসত্য। পাকিস্তানী স্বৈরশাসক গোলাম মোহাম্মদ, ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের নজিরবিহীন সংবিধান লঙ্ঘন, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি শাসিত স্বৈরতন্ত্র চালু এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে সংসদীয় গণতন্ত্র হত্যা করার জবাবেই ছয়দফা ও মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। ১৯৭২ এর সংবিধান ছিলো ওয়েস্ট মিনষ্টারে হাজার বছর ধরে চর্চিত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ও জবাবদিহিমূলক সংসদীয় গণতন্ত্রের আত্নীকরণ যেটির প্রতিশ্রুতি ১৯৫৬ সালের সংবিধানে দেয়া হয়েছিলো। পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা সেটিকে মাত্র দুই বছরের মাথায় হত্যা করেন। সুতরাং এটি কোন বিচারেই আইয়ুব-ইয়াহিয়ার পাকিস্তানী শাসনযন্ত্রের অনুকরণ নয়।

প্রশ্ন আসতে পারে, সংবিধান প্রণেতাদের ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থার মতো ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাকেই বেছে নিতে হলো কেন। এ প্রশ্নটি ১৯৭২ এর গণপরিষদ বিতর্কেও এসেছে। সংবিধান প্রণেতারা ভারত শাসন আইন ১৯০৯, ১৯১৯ এবং ১৯৩৭ এর ধারাবাহিকতার কথা বলেছেন। সংসংদীয় গণতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা বলেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ১৯৯২ সালে একটি সর্বদলীয় সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ওয়েস্ট মিনস্টার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে আমাদের এদেশে এ ব্যবস্থার উপর একটি জাতীয় ঐকমত্যও হয়ে গেছে।

তৃতীয় যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে ১৯৭২ এর সংবিধান রচনার সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাঁদের মতামত বিবেচনা করা হয়নি।

আমরা মনেকরি এ যুক্তিটি কিছুটা বিভ্রান্তিকর। ১৯৭২ সালের গণপরিষদ বিতর্ক, সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন, এর উপর জনমত আহ্বান ও এগুলোর বিচার বিবেচনা অনেক বড় পরিসরে হয়েছে। গণপরিষদ বিতর্কের কার্যবিবরণী পড়লে দেখা যায়, সংখ্যালঘু মতের সদস্যরা তাঁদের অনেকগুলো মতামত গৃহীত না হওয়ায় অনুযোগ প্রকাশ করলেও, বিতর্কে তাঁদের অংশগ্রহণের পর্যাপ্ত সুযোগের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর কিছু অংশ নবগঠিত বিরোধী দল জাসদে যোগ দিয়ে সংবিধানের বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা সংসদীয় ধাঁচের ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছেন, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন, রাষ্ট্রবিনির্মানের অংশীদার হিসেবে পিপলস আর্মি-র কথা বলেছেন।

তবে ঐতিহাসিক বাস্তবতায় দেখা যায়,তাঁরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কি, সেটি কিভাবে বাস্তবায়ন করবেন সেটি কখনো স্পষ্ট করেননি। বাংলাদেশের মুল ধারার রাজনিতিতেও জাসদ সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। ১৯৭৫ এ রক্তাক্ত রাজনৈতিক পরিবর্তনের অন্যতম অণুঘটক হিসেবে আবির্ভূত হলেও, এর অব্যবহিত পরেই দলটি প্রাসঙ্গিকতা হারায়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে অংশগ্রহণের কোন সংকট যদি থেকে থাকে সেটি সম্ভবত মুসলিম লীগ সহ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অংশ নিতে না পারার মধ্যে থাকতে পারে।এটি ১৯৭২ সালের রাজনৈতিক বাস্তবতা হলেও, ১৯৭৫ এর পর এ দলগুলো রাজনীতিতে পুনঃস্থাপিত হয়।

১৯৭৫ এর পর সংবিধানের মুল নীতি, যেমন ধর্ম নিরপকেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে পরিবর্তন আসে। মুলনীতিগুলো নিয়ে কিছুটা স্তিমিত রাজনৈতিক বিতর্ক এখনো চলমান থাকলেও, ১৯৯২ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ, বিএনপি-সহ সব দলের ঐকমত্যের ফলে দেখা যায় মুল সংবিধানের কাঠামোগত ব্যবস্থাটির উপর একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

চতুর্থ যুক্তি দিয়ে বলা হচ্ছে ১৯৭২ সালের সংবিধান এলিট প্রেফারেন্স হিসেবে এসেছে। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ সেখানে ছিলো না। জনগণের উপর এটি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

আমরা স্বীকার করি “এলিট প্রেফারেন্স” যুক্তিটি একাডেমিক মহলে জনপ্রিয়। ভারতীয় রাজনৈতিক দার্শনিক পার্থ চ্যাটার্জিসহ সাব অল্টার্ন স্টাডিজের স্কলাররা জোর দিয়েই বলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো পলিটিক্যাল এলিটরা নেয়। প্রান্তিক মানুষের সেখানে অংশনেয়ার সুযোগ কম। এ যুক্তিটি তাঁরা দেন মূলত সমাজের ক্ষমতা কাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সম্পদসহ নানা ক্ষেত্রে সুযোগের অসমতায় মানুষের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে বাধাগুলোর দিকে ইঙ্গিতকরে। এগুলো সামাজিক রূপান্তরের প্রশ্ন। এ ধরণের যুক্তিগুলো দেয়া সহজ, বাস্তবে তেমন ধরণের সমতার সমাজ বিনির্মাণ করে সংবিধান লেখা বা সংস্কার করা অনেকটাই অসম্ভব। সেটি ১৯৭২ সালে যেমন অসম্ভব ছিলো, ২০২৪সালেও তেমনটি আছে।

উল্টো করে বলতে গেলে বর্তমানের সংবিধান সংস্কার কমিশনের চেয়ে ১৯৭২ সালের গণপরিষদ যোজন যোজন বেশি প্রতিনিধিত্বমুলক, দেশজ এবং মাটি ঘেঁষা ছিলেন। জনগণের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রায়োগিক কথা হচ্ছে, ১৯৭২ এ সংবিধানের উপর আলাপ আলোচনাও এতে অংশ নেয়ার সুযোগ সাধারণভাবে আগ্রহী যে কারো জন্য উম্মুক্ত ছিলো কিনা। এর একেবারে ঐতিহাসিক সত্য উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ।

স্পষ্টতই ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়নের “গলদ” সংক্রান্ত উপরোল্লিখিত যুক্তিগুলো যতটা না বুদ্ধিভিত্তিক সততা থেকে তোলা হচ্ছে সম্ভবত তারচেয়ে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের উপর গড়ে উঠা ১৯৭২ এর গণপরিষদে মূল সংবিধান প্রণেতাদের সংবিধান লেখার অধিকার ও প্রক্রিয়াকে প্রচ্ছন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্যে তোলা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হতে পারে। এ লেখার পরের পর্বে আমরা ১৯৭২ সালের সংবিধানের যে “ত্রুটি”গুলো সনাক্ত করা হয়েছে সেগুলো আলোচনা করার চেষ্টা করবো।

Saturday, October 26, 2024

The Reform Agenda: Are We Missing Something?

 

The Reform Agenda: Are We Missing Something?

 

Dr M Jashim Ali Chowdhury

Lecturer in Law, University of Hull, UK

Published in: The Daily Observer, Dhaka, 26 October 2024

Link: https://www.observerbd.com/news/496552

 

REFORM seems to be a recurring theme of our national life. In 1972, our founding fathers promised a clean break from the twenty-four-year-long abusive presidential rule of the Pakistani military establishment. They promised a parliamentary democracy enshrined by some foundational pillars of constitutionalism. It did not serve us. In 1975, they preached “a second revolution” and transformed the system into a one-party presidential dictatorship. Months later, the country fell into bloodshed, and utter chaos. The 1976-79 period was full of constitutional reform, revision and rewriting. Constitutional ideals were tweaked, and multi-party politics was brought back but the presidential system endured. The 1980s also oversaw bloodshed and another military coup. Military rulers suspended the Constitution, changed its fundamental principles, tweaked its institutional design, created new political parties, rehabilitated some old ones and undertook high-profile anti-corruption drives. However, the presidential autocracy, corruption, vote rigging and pollution of politics did not stop.  The country oversaw the first significant mass upsurge in 1990. The military rule was discredited and the prospect of civilian rule ushered.

 

In 1991, a promising institution of election-time caretaker government was born and the parliamentary system returned. However, bipartisan politics became competitively authoritarian, conflictive, violent and conspiracy-laden. Regular transfer of power became a very big ask. The caretaker government proved a breathing space for democratic sustenance. The parliamentary system, however, failed to remedy the problems of non-accountability, corruption, and the cartelisation, criminalisation and personalisation of politics. The election-time caretaker government apart, there was no sign of institution-building in other areas of governance, accountability and justice. Local government, anti-corruption commission, election commission, judiciary, bureaucracy and parliament – all succumbed to the invincible dictatorship of the government – particularly the prime minister. By 2006, the caretaker government also was brought to its knees.

 

In 2007, the military returned to the scene and promised the nation to fix its problems once and for all. The 2006-2007 government initiated another round of anti-corruption drive, loaded a thinly veiled attack on the political parties and attempted a much-hyped “minus-two” solution. However, the initial zeal faded within one and a half years. The military leadership had to hand over the power. They, however, remarkably separated the lower judiciary and brought significant reform around the Election Commission’s powers and structure. Notable reforms were pressed in the Anti-Corruption Commission and other accountability institutions. In 2009, a political party came to power by laying down a hugely popular "Din Bodoler Sonod". However, the days went from bad to worse. For the next sixteen years, Bangladesh went through the longest stretch of one-party dominance and authoritarian premiership in its history.

 

In 2024, history repeated itself through another round of bloodshed, agonising violence, street agitation and a mass upsurge. With an “interim government” in power, there is now another drive for reform in almost every sector of the state, including the Constitution. Key issues in the agenda are strikingly similar to what we have seen time and again since our independence – institution building, accountability, rule of law, independence of the judiciary, free and fair elections and corruption-free governance. Some are blaming the Constitution’s foundational principles for all our enduring problems. They want to rewrite them, forgetting that we made, unmade and remade those at least four times in the past – 1975, 1979, 1988 and 2011. Others argue that the constitutional design is flawed. They want to overhaul it, again forgetting that we made, unmade and remade it at least five times in the past – 1975, 1979, 1992, 1996 and 2011. Academic researchers usually blame the lack of “political will” and “democratic instrumental vision” among the political leaders. However, nobody seems to seriously talk about the political parties themselves.

 

Since its birth, Bangladesh had at least three clear moments of fresh starts – 1972, 1991 and 2009. On each of these occasions, the political parties and their leaders inherited the best possible institutional arrangements and political consensus. However, they failed us miserably on every occasion. They unmade whatever progress was there and then consolidated and perpetuated their powers. Now that they are again proposing and promising a stitch or two here and there, 31 points, 10 points, etc., the bigger question is - Could we trust them anymore?

 

Constitutional designs of ‘institutions, structures, organizations and legal framework’ are meant to enable the state to function as a self-governing system. However, it is the political parties who operate, rather say spoil,  it. Surprisingly for Bangladesh, parties have always lived beyond the limits and rules of the Constitution. Renowned political scientist Richard Pildes has shown that constitutions can deal with parties in at least three ways. It can ensure equal access to democratic competition and proportionate access to state finance for all. Next, it can create minority safeguards within the institutions such as parliament and protect the parties against unconstitutional bans. Lastly, it can ensure that parties themselves are internally democratic and accessible to the people (Richard Pildes, ‘Foreword: The Constitutionalization of Democratic Politics’ (2004) 118 (1) Harvard Law Review 1).

 

The 2024 reform window must ensure that political parties are brought into the constitutional framework of democratic accountability.  It must address the historically ignored questions - how the parties form and behave, where they get their money from, where they spend it, how they choose their leaders, and how they answer the people. Missing a conversation on this key issue of democratic accountability, how can we rest assured that the reforms of 2024 will be respected by the internally undemocratic political parties and their parochial leaders?




Thursday, October 17, 2024

সংস্কারপ্রক্রিয়া ও কিছু উপেক্ষিত প্রশ্ন




ড. এম জসিম আলী চৌধুরী
প্রকাশ :দৈনিক আজকের পত্রিকা, ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৪৫


‘সংস্কার’ আমাদের এক পৌনঃপুনিক নিয়তি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতারা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ২৪ বছরের স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতিতন্ত্র থেকে চিরস্থায়ী মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক ভিত্তিগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে তাঁরা সংসদীয় গণতন্ত্রব্যবস্থা বেছে নেন। কিন্তু এ সুখ আমাদের বেশি দিন সয়নি। ১৯৭৫ সালে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর ডাক দিয়ে একটি জাতীয় দলভিত্তিক রাষ্ট্রপতির শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়। এটিও টেকেনি। কয়েক মাসের মধ্যেই দেশ রক্তপাত এবং চরম বিশৃঙ্খলার ভেতর পড়ে যায়। ১৯৭৫-৭৯ সময়কালটা পুরোটাই সংবিধান সংস্কার, সংশোধন এবং পুনর্লিখনে কেটেছে। এ সময় সংবিধানের মূলনীতিগুলোকে পরিবর্তন করা হয়। বহুদলীয় রাজনীতি ফিরিয়ে আনা হলেও রাষ্ট্রপতিব্যবস্থা রেখে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থাকে বরং আরও সংহত করা হয়। ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে আবার রক্তপাত এবং আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান। এবার এক সামরিক শাসক সংবিধান স্থগিত করেন, নিজে একটি অন্তর্বর্তী সংবিধান দেন এবং সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলোকে আরও পরিবর্তন করেন। ১৯৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত সময়ে দেশে বড় দুটি রাজনৈতিক দল জন্ম নেয়। জামায়াতে ইসলামী পুনঃস্থাপিত হয়। আওয়ামী লীগও বাকশাল ছেড়ে নিজের জায়গায় ফিরে আসে। সামরিক সরকারগুলো প্রথম দিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। তারপর আস্তে আস্তে রাষ্ট্রপতি স্বৈরাচার, দুর্নীতি, ভোট কারচুপি ও রাজনীতির দূষণে মেতে ওঠে। সংসদ, স্থানীয় সরকার, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারপ্রধানের এবং সরকারি দলের খামখেয়ালির কাছে জিম্মি থেকে যায়। ১৯৯০ সালের শেষের দিকে স্বাধীন দেশের প্রথম গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। সামরিক শাসন বিদায় নেয় এবং বেসামরিক শাসনের সূচনা হয়।



















১৯৯১ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের একটি প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিষ্ঠান জন্ম নেয় এবং সংসদীয় ব্যবস্থা ফিরে আসে। তবে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণের মধুচন্দ্রিমাও বেশি দিন টেকে না। দ্বিদলীয় ব্যবস্থাটা প্রতিযোগিতামূলকভাবে কর্তৃত্ববাদী, সংঘাতপূর্ণ, ষড়যন্ত্র এবং কূটচালের রাজনীতি হয়ে ওঠে। নিয়মিত ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর কেন জানি অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৬ সালে আবার জ্বালাও-পোড়াও ও গণ-আন্দোলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসে। গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার রদবদল টিকিয়ে রাখার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনেকটা নিশ্বাস ফেলার জায়গা হয়ে দাঁড়ায়। সংসদীয় ব্যবস্থা অবশ্য জবাবদিহিহীনতা, দুর্নীতি এবং রাজনীতির পারিবারিকীকরণ, দুর্বৃত্তায়ন এবং গোষ্ঠীস্বার্থের আখড়ায় পরিণত হয়। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আর কোথাও সামগ্রিকভাবে জবাবদিহিমূলক শাসন ও ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। স্থানীয় সরকার, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, আমলাতন্ত্র এবং সংসদ—সবই দলীয় সরকার এবং সরকারপ্রধানের অদম্য ক্ষমতালিপ্সার কাছে আত্মসমর্পণ করে। ২০০৬ সাল আসতে আসতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটিও নষ্ট করে দেওয়া হয়।


২০০৭ সালে সামরিক বাহিনী আবার দৃশ্যপটে আসে। তারা রাষ্ট্রের সমস্যাগুলো একবারে এবং চিরতরে সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেয়। আবারও ‘দুর্নীতিবিরোধী অভিযান’ শুরু হয়। এবার বড় দুটি রাজনৈতিক দলের ‘সংস্কার’ কাজে হাত দেওয়া হয়। বহুল প্রচারিত ‘মাইনাস-টু’ ফর্মুলার মাধ্যমে দলের নেতৃত্ব পরিবর্তনের চেষ্টা চলে। তবে একই সঙ্গে সেনাপ্রধানের নিজের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ প্রকাশ হতে থাকায় ফর্মুলাটি দ্রুতই আকর্ষণ হারায়। সংস্কারের প্রাথমিক উদ্যম দেড় বছরের মধ্যে ম্লান হয়ে আসে। ২০০৮- এর শেষের দিকে সামরিক নেতৃত্বকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হলেও তাঁরা নিম্ন আদালতকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করে যান এবং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও কাঠামোয় উল্লেখযোগ্য সংস্কার আনেন। দুর্নীতি দমন কমিশন এবং অন্যান্য জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও উল্লেখযোগ্য সংস্কার করা হয়। ২০০৯ সালের শুরুতে ‘দিনবদলের সনদ’ নামে ব্যাপক জনপ্রিয় একটি রাজনৈতিক মেনিফেস্টো দিয়ে একটি বড় দল ক্ষমতায় আসে। কিন্তু দিন বদল হওয়ার বদলে খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে। পরবর্তী ১৬ বছর বাংলাদেশ তার ইতিহাসের দীর্ঘতম একদলীয় আধিপত্য এবং কর্তৃত্ববাদী প্রধানমন্ত্রীর শাসনের ভেতর দিয়ে যায়।


২০২৪ সালে আরেক দফা রক্তপাত, যন্ত্রণাদায়ক সহিংসতা এবং ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনে ওই সরকারের পতন হয়েছে। এখন একটি ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ ক্ষমতায় এসে সংবিধানসহ রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে আবার সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে। সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো স্বাধীনতার পর থেকে যেগুলো আমরা বারবার দেখে আসছি সেগুলোই—প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, জবাবদিহি, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দুর্নীতিমুক্ত শাসন।


এখন অনেকেই সমস্যাগুলোর জন্য সংবিধানের মূলনীতিকে দায়ী করছেন। তাঁরা ওগুলো নতুন করে লিখতে চান। অথচ মূলনীতিগুলো আমরা অতীতে অন্তত চারবার পাল্টেছি, ভেঙেছি ও গড়েছি (১৯৭৫, ১৯৭৯, ১৯৮৮ এবং ২০১১)। অন্য অনেকে বলছেন, সাংবিধানের মূলনীতি না বরং কাঠামোটাই ত্রুটিপূর্ণ। তাঁরাও কাঠামোটিকে নতুন করে সাজাতে চান। অথচ কাঠামোটাও আমরা অতীতে অন্তত পাঁচবার উল্টেপাল্টে দেখেছি (১৯৭৫, ১৯৭৯, ১৯৯২, ১৯৯৬ এবং ২০১১)। এতবার সংস্কারের এতবার ব্যর্থতার জন্য একাডেমিক গবেষকেরা পাইকারিভাবে ‘রাজনৈতিক ইচ্ছা’ এবং রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ‘প্রাতিষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব’কে দায়ী করেন। অথচ রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার নিয়ে সরাসরি কিছু বলেন না। এবারো বলছেন না।


বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে ২০২৪-এর আগপর্যন্ত আমরা অন্তত তিনটি নতুন করে শুরু করার মুহূর্ত পেয়েছি—১৯৭২, ১৯৯১ এবং ২০০৯। প্রতিটি মুহূর্তে রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতারা সময়ের সম্ভাব্য সেরা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য পেয়েছিলেন। অথচ প্রতিটি মুহূর্তই শোচনীয় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ক্ষমতা পাওয়া রাজনৈতিক দলগুলো যেটুকু ভালো পেয়েছিল তার সবটুকু নষ্ট করে দিয়ে তাদের নিজেদের ক্ষমতাকে সুসংহত ও স্থায়ী করায় মনোযোগ দিয়েছে। ২০২৪ সালে এসেও তারা এখানে-ওখানে এই সংস্কার, ওই সংস্কার, ৩১ দফা, ১০ দফা ইত্যাদি প্রস্তাব-প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। প্রশ্ন হলো, আমরা কি তাদের আর আদৌ বিশ্বাস করতে পারি?


সংবিধানে যে প্রাতিষ্ঠানিক এবং আইনি কাঠামো দেওয়া হয়, সেগুলো দেওয়া হয় রাষ্ট্র যেন একটি স্বশাসিত ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে সে উদ্দেশ্যে। সংবিধান নিজে এগুলো বাস্তবায়ন করবে না। রাজনৈতিক দলগুলোই এগুলো বাস্তবায়ন (বা ধ্বংস) করবে। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা সব সময়ই সংবিধানের সীমা ও নিয়মের বাইরে থেকে গেছে।



প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রিচার্ড পিল্ডাস দেখিয়েছেন যে সংবিধান কয়েকটি উপায়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে জবাবদিহি করাতে পারে। সংবিধান গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় সব দলের সমান অংশগ্রহণ এবং সবার জন্য সমর্থন অনুপাতে রাষ্ট্রীয় তহবিল বরাদ্দ দিয়ে তাদের আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। সংসদের মতো প্রতিষ্ঠানে রাজনীতিতে স্থায়ী সংখ্যালঘুদের জন্য আসন সংরক্ষণ করার মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্থায়ী কর্তৃত্বের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে পারে। নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলোকে অসাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। সবশেষে, এটা নিশ্চিত করতে পারে যে দলগুলো নিজেরা অভ্যন্তরীণভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জনগণের ভেতর থেকে নেতৃত্ব উঠে আসার পথ খোলা রাখবে।


২০২৪-এর সংস্কার প্রকল্পের একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ হতে হবে, রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারকে নষ্ট করার কাজটি যেন আর করতে না পারে। এবারের সংস্কার অ্যাজেন্ডায় রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার এবং তাদের সংবিধানের কাঠামোর ভেতরে নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। জনগণকে জানতে হবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে গঠিত হয়, কীভাবে চলে, অর্থ কোত্থেকে পায়, খরচ কোথায় করে, তাদের নেতা কীভাবে নির্বাচিত হয় এবং জনগণের বা রাষ্ট্রের কাছে তাদের জবাবদিহি কোথায়। এবারের সংস্কারকে সফল হতে এবং দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে উপেক্ষিত এ প্রশ্নগুলোর সমাধান হতে হবে।


লেখক: প্রভাষক, আইন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব হাল, যুক্তরাজ্য



Constitution, legitimacy, and governance: Addressing the hard questions






Dr M Jashim Ali Chowdhury
Md Imamunur Rahman


Published in: The Daily Star, Law and Our Rights, Dhaka: 11 October 2024



There are some serious debates around the constitutionality of Bangladesh's interim government. We have seen attempts to justify it both in terms of Hans Kelsen's Grundnorm theory and the existing Constitution. Kelsen's Grundnorm is a sovereign law-giver and a "purely" political authority, which the law accepts as it is, without questioning its validity, legality, or constitutionality. Understandably, the interim government has effective control over the state, and the August political change has become a ground reality. The Pakistani Supreme Court used the Grundnorm as a judicial doctrine of constitutional validation only once in 1960. It has been widely criticised since and never used again for validation of any extra-constitutional changes either in Pakistan or Bangladesh. Therefore, in this article, we do not intend to enter into the nitty-gritty of the Kelsenian thesis. Rather, we explore whether the attempts to justify the interim government in terms of our existing Constitution are viable. We argue that the existing Constitution-based justifications are self-defeating vis-à-vis the Kelsenian logic. Those are not viable within the framework of the existing Constitution either. We propose that the interim government is best described as residing in a "constitutional emptiness," which might need constitutional validation after a democratic election in the near or distant future.


At the very outset, we stress that Chief Justice Munir of the Pakistan Supreme Court, the pioneer who converted Kelsen's theory into a doctrine of constitutional adjudication, perceived the overthrowal of a constitutional regime as an extra-constitutional phenomenon which does not seek to justify itself with reference to the previous constitutional framework. Chief Justice Munir did not attempt to justify Ayub Khan's asssumption of power with reference to any of the provisions of Pakistan's 1956 Constitution. He was content claiming that an effective revolution had occurred, and the 1956 Constitution got dislodged. Ayub gave a new Constitution of his choosing in 1962.


In the 1970s and 80s, Bangladesh Supreme Court took a slightly different approach in several cases, where they argued that, in those types of situations, the existing Constitution, though not dislodged, might have lost its supremacy (State v Haji Joynal Abedin, for example). Accordingly, when elected governments were formed later, they constitutionalised those scenarios through the Fifth and Seventh Amendments, essentially confirming that those regimes were extra-constitutional, to say the least. In 1991, we saw Chief Justice Shahabuddin Ahmed's post-revolution government validated by the Eleventh Amendment, confirming a similar understanding of revolutionary changes. Therefore, it appears rather self-defeating to argue on the one hand that a Kelsenian revolution has overridden an existing constitutional setup and, on the other hand, that the revolutionary government is valid under the same Constitution. This approach is not viable in terms of the existing Constitution either.


Take for example, the argument that the "absence" of the Prime Minister from the country has made the article 57(3) of the Constitution, which stipulates that the Prime Minister holds office until a successor is appointed, "inoperative" or "irrelevant". This argument closely aligns with the Kelsenian logic above. In such situations, the Constitution, in general, comes to a point of irrelevance, making it redundant to find justification therefrom. If we talk within our current Constitutional framework, the Prime Minister's departure from the country is indeed unusual but it does not make Article 57(3) irrelevant or inoperative. This may lead to a further conundrum of interpretation especially when the things to do in the absence of a head of government are well described in the Constitution.




Another argument is that during the absence of the head of government, the President incurs "elevated" responsibilities, potentially allowing him to lead the government himself, or appoint a "successor" who need not be another Prime Minister. This argument deeply contradicts Article 55 of the Constitution, which is currently the only constitutional route to form a government. Moreover, under Article 57(2), the President has a clear constitutional duty to find, instead of "elevating his duties," whether a new Prime Minister who holds the support of the majority of MPs can be appointed. It does not permit the President to dissolve Parliament simply because the Prime Minister has presumably resigned or abdicated the office by absence. More explicitly, Article 72(1) requires the President to dissolve Parliament only on the Prime Minister's written advice. The President cannot dissolve Parliament unilaterally or on the advice of anyone other than the Prime Minister (Mahmud Islam, Constitutional Law of Bangladesh (2012), p. 406). In August's extraordinary situation, the dissolution of Parliament was the call of the student protesters. That was, however, an action of the new Grundnorm, if we say so. The parliament dissolution of August was not conceivable or justifiable within our existing Constitution. Hence, trying to justify it by bringing in an "elevated duty" hypothesis may not be sustainable within the existing constitutional disposition.


It has also been argued that the Prime Minister's departure from Bangladesh was an extraordinary situation requiring the President to seek the opinion of the Supreme Court under Article 106 to move forward. However, the Supreme Court's advisory opinion under Article 106, though an extremely valuable opinion, is by definition not a law with binding constitutional force (Special Reference No. 1 of 2009 (2010)). Moreover, the detailed reasoning of the Supreme Court has not been made publicly available yet. While the Court might have considered either, or any combination of, the doctrines of necessity, efficacy, or revolutionary legality, all those would still lie outside the domain of our existing Constitution.


Considering the above, we argue that Bangladesh's current interim government is thriving in a "constitutional emptiness" and will require a retrospective validation either within the existing or in a potentially "new" Constitution in the near or distant future.


(The writers are Lecturer in Law, Faculty of Business, Law and Politics at the University of Hull, United Kingdom, and Assistant Professor and Chair in the Department of Law at Z. H. Sikder University of Science and Technology, Bangladesh, respectively.)

Tuesday, September 3, 2024

‘বদলে না যাওয়া’ বাংলাদেশ


‘বদলে না যাওয়া’ বাংলাদেশ

ড. এম জসিম আলী চৌধুরী
প্রভাষক, ইউনিভার্সিটি অব হাল, যুক্তরাজ্য

লেখাঃ ১৩ জুন ২০২৪
প্রকাশঃ দৈনিক আজকের পত্রিকা (৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪)
পত্রিকার লিংকঃ https://epaper.ajkerpatrika.com/textview/123671/1995161664.html 


১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সদ্য ভূমিষ্ঠ রাষ্ট্রের সরকার শপথ গ্রহণ করে এবং স্বাধীনতার সরকারি ঘোষণাপত্র (প্রকলেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স) প্রকাশ করে। ঘোষণাপত্রে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় গণতন্ত্র, জনগণের ক্ষমতায়ন ও আইনের শাসনের অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়। অঙ্গীকারটি কেবল কথার কথা ছিল না। এর পেছনে দেশের স্বাধীনতাকামী নেতৃত্বের গভীর সংকল্প ও সদিচ্ছা ছিল। দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনার স্বার্থে ওই সময় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা হলেও যুদ্ধ শেষ হওয়ার এক মাসের ভেতরেই তারা সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় ফেরত যায় (অন্তর্বর্তী সংবিধান আদেশ, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২)। রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা থেকে অধিকতর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যেতে আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা সময় নিতে পারতেন। নতুন দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সংবিধান প্রণয়নের জন্য অপেক্ষা করার অজুহাত দিতে পারতেন। ইচ্ছের সততায় (সিনসিয়ারিটি অব ইনটেনশন) তাঁরা সেটি করেননি। অন্তর্বর্তী সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সংসদীয় সরকারের চেতনা, আবহ ও কাঠামোর সুস্পষ্ট চিত্রায়ণ ছিল। এটিই ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে গৃহীত সংবিধানের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রকাঠামোটি মোটা দাগে এমন—ব্রিটিশ রাজার আদলে দেশের প্রতীকী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং জনগণের রায়ে নির্বাচিত ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভা নিয়ে দেশের নির্বাহী বিভাগ গঠিত (সংবিধানের চতুর্থ ভাগ)। জনগণের রায়ে নির্বাচিত জাতীয় সংসদকে দেওয়া হয়েছে আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের নিয়ন্ত্রণ এবং সরকারের প্রাত্যহিক ও চূড়ান্ত জবাবদিহির দায়িত্ব (সংবিধানের পঞ্চম ভাগ)। রাষ্ট্রীয় জীবনে সংবিধানের বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রের আইনকানুন প্রয়োগে সরকারের ক্ষমতা চর্চার লাগাম টানা, জনগণের মৌলিক অধিকার সুরক্ষা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দায়িত্ব পড়েছে বিচার বিভাগের ওপর (সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগ)। দেশের তৃণমূলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানের নির্বাহী বিভাগ অংশে উল্লেখ করা হলেও সেখানে কেন্দ্রের বা আমলাতন্ত্রের শাসনের বদলে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসনের নিশ্চয়তা দিতে আলাদা অধ্যায় যোগ করা হয়েছে (সংবিধানের চতুর্থ ভাগ, তৃতীয় অধ্যায়)।

সরকার, সংসদ ও আদালতের বাইরে একেবারে আলাদা একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে তুলে ধরা হয়েছে (সংবিধানের সপ্তম ভাগ)। সংবিধানের অষ্টম ভাগে আলাদা করে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রের মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়কে। সংবিধানের নবম ভাগে দেশের জনপ্রশাসনে কর্তব্যরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও মৌলিক কিছু সাংবিধানিক সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। আমলাদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারি কর্মকমিশনকেও আলাদা করে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে (নবম ভাগ, দ্বিতীয় অধ্যায়)। সংবিধানে সরকার, সংসদ ও আদালতের মতো বড় বড় তিনটি প্রতিষ্ঠানের পাশে এ চারটি তুলনামূলক ছোট প্রতিষ্ঠানকে এমন বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করাটা অর্থহীন কিছু নয়। সন্দেহ নেই, আমাদের স্বাধীনতার নায়করা দেশের তৃণমূল থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত গণতান্ত্রিক শাসন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধি বাছাই, রাষ্ট্রীয় তহবিলের জবাবদিহি এবং জনপ্রশাসন তথা আমলাতন্ত্রের রাজনীতি ও দলীয়করণমুক্ত থাকাকে এই পুরো কাঠামোর ভিত্তি বলে মেনেছেন।

সংবিধান প্রণয়নের ৫২ বছর পর পেছন ফিরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোটিকে দেখলে আমাদের কিছুটা বিষণ্ণতা গ্রাস করে। ৫০ বছরের এ যাত্রায় এ কাঠামোর অনেক বাঁকবদল ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। আমরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের সরকার, জাতীয় দলকেন্দ্রিক রাষ্ট্রপতির সরকার, সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রপতির সরকার, নির্বাচনকালীন অনির্বাচিত সরকার এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিযোগিতামূলকভাবে কর্তৃত্ববাদী সংসদীয় সরকারব্যবস্থার ভেতর দিয়ে গেছি। এত সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষে এসে দেখা যাচ্ছে, আমাদের স্বাধীনতার নায়করা যে রাষ্ট্রকাঠামো বাতলে গেছেন, সেটির কঙ্কালসার অবয়বটিই কেবল অবশিষ্ট আছে। কাঠামোটির অন্তর্গত চেতনা, লক্ষ্য ও আদর্শ হারিয়ে যেতে বসেছে।

মোটা দাগে রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সরকারগুলো প্রতিষ্ঠান বা সংবিধানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়ার চেয়ে ব্যক্তি বা দলীয় প্রধানকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। দেশের একাডেমিক মহলে একটি মৃদু সমালোচনা আছে যে সংবিধানপ্রণেতারা সংসদীয়ব্যবস্থার ভেতর সরকারপ্রধানের ক্ষমতা কিছুটা বেশি দিয়েছিলেন। গভীর বিবেচনায় এ সমালোচনাটিকে কিছুটা অপরিপক্ব বলে মনে হয়। ১৯৭০ সালের এক পাবলিক লেকচারে লর্ড হেইলসাম ব্রিটিশ ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থাকে ‘প্রধানমন্ত্রীর স্বৈরতন্ত্র’ আখ্যা দিয়েছিলেন। এ ব্যবস্থাটি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে স্বীকার করেই সাজানো। এখানে নিয়ন্ত্রণ আসে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ চাপ, সংসদের বিরোধী দল, শক্তিশালী ও স্বতন্ত্র স্থানীয় সরকার, স্বাধীন বিচার বিভাগ, শক্তিশালী গণমাধ্যম ও জবাবদিহি নিশ্চিতকারী অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। আমাদের মতো উপনিবেশ-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোতে জবাবদিহির এ ব্যবস্থাগুলো অনুপস্থিত থাকায় বা শক্তিশালী না হওয়ায় ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থার প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিকতাটিকে অতিরিক্ত চোখে পড়ে।





























বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় কখনো কখনো নির্বাচিত প্রতিনিধির শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা গেলেও সেটি সংহত, নিরবচ্ছিন্ন ও কার্যকর হওয়ার আলামত সুস্পষ্ট নয়। স্থানীয় সরকারে কেন্দ্রীয় সরকার ও মাঠপর্যায়ের আমলাতন্ত্রের হস্তক্ষেপ জোরালো। গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের হস্তক্ষেপপ্রবণতা। এতগুলো ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে অযাচিত হস্তক্ষেপ দেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে অনেকটাই জিম্মি করে ফেলেছে। আমলাতন্ত্রের রাজনীতি-নিরপেক্ষ পেশাদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠার মতো পরিবেশ, পরিস্থিতি বা এর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কখনোই দেখা যায়নি। স্বাধীন স্বতন্ত্র সরকারি কর্ম কমিশনও দৃশ্যমান হয়নি।

বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের আইনসভা সে অর্থে সরকারের জবাবদিহির জায়গা হয়ে উঠতে পারেনি। প্রায় সবাই এ জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদকে দায়ী করলেও সংসদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব-প্রতিপত্তি কেবল সংসদ সদস্যদের দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে না পারার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বলেই মনে হয়। আসল সমস্যাটি আমাদের রাজনৈতিক দলব্যবস্থার ভেতর থেকে আসে, যেখানে গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, তৃণমূলের পছন্দে দলের মনোনয়ন লাভ বা নেতৃত্বের স্থানে উঠে আসার সুযোগ অনুপস্থিত। ফলে সংসদ সদস্যের পক্ষে দলের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরোধিতা করা বা সরকারের নীতির বিরোধিতা করা অনেকটাই রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল। ব্যাপারটি শুধু সংসদে ভোট দেওয়াতে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সংসদের প্রশ্নোত্তর, সংসদীয় বিতর্ক বা সংসদীয় কমিটির জবাবদিহিমূলক কর্মকাণ্ডের পুরোটাতেই প্রভাব ফেলে।

জনপ্রিয় ভাষ্যে দেশের বিচার বিভাগকে ‘জনগণের আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল’ বলা হলেও সামরিক শাসন এবং অনেক রাজনৈতিক সরকারের সময়ও বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগকে খুব বেশি নাড়া দিতে পারেনি। উচ্চ আদালতের নিয়োগপ্রক্রিয়ার অতি রাজনৈতিকীকরণের প্রবণতা প্রায়ই দৃশ্যমান ছিল। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৬ অনুচ্ছেদে সংবিধানপ্রণেতারা স্পষ্টভাবে অতিসত্বর নিম্ন আদালত পৃথক্‌করণের তাগিদ দিয়েছিলেন। অথচ কাজটি শুরু করতে আমাদের প্রায় ৩৫ বছর লেগেছে (২০০৭) এবং এর পরের ১৮ বছরেও আমরা কাজটি পুরোপুরি সমাধা করতে পারিনি।

সন্দেহ নেই যে আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং এতে জনগণের আস্থা ফেরার আশু কোনো লক্ষণ নেই। অনেকে এটার জন্য দলগুলোর আদর্শিক অবস্থানের চরম মেরুকরণ, এর ফলে সৃষ্ট প্রতিহিংসা ও ক্ষমতার রাজনীতিকে দায়ী করেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি এটাকে দলব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রহীনতার সমস্যা বলে মনে করি। আন্তদলীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া জারি থাকলে আন্তদলীয় প্রতিযোগিতা অনেকটাই গা-সওয়া হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ বা হারানোকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হতো।

মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়কে সংবিধানপ্রণেতারা যেভাবে একটি স্বতন্ত্র সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চেয়েছেন, সেটি আদতে হয়নি। এটি সরকার প্রশাসনের ভেতর একেবারে আত্তীকৃত হয়ে গেছে। আলাদা করে জনগণের চোখে পড়েনি। আমলাতন্ত্রের জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংসদের নিজস্ব ব্যবস্থা হিসেবে ন্যায়পাল নিয়োগের একটি বিধান (৭৭ অনুচ্ছেদ) সংবিধানপ্রণেতারা দিলেও সেটি এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। সময়ে সময়ে আইনের মাধ্যমে কিছু জবাবদিহির প্রতিষ্ঠান (যেমন দুর্নীতি দমন, মানবাধিকার, তথ্য ও নদী কমিশন) আমরা তৈরি করেছি বটে, কিন্তু সেগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে চেয়েছি—এমনটা দাবি করা কঠিন।

যুক্তরাজ্যের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির শিক্ষক ড. কুমারাসিঙ্গাম দক্ষিণ এশিয়ার সরকারব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁর পিএইচডি থিসিসে তিনি দাবি করেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যখন প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, তখন ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থাটি একধরনের ‘ইস্টমিনস্টার’ ব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়। কিছুটা হেঁয়ালি করে বলা যেতে পারে, আমাদের স্বাধীনতার নায়করা সম্ভবত একটি ‘ইস্টমিনস্টার’ ধাতে বেড়ে ওঠা সমাজকে একটি ‘ওয়েস্টমিনস্টার’ ধাঁচের রাষ্ট্রকাঠামো দিতে চেয়েছেন। ফলে বিগত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বৈষয়িক উন্নয়ন সূচকের অভাবনীয় বদল হলেও রাষ্ট্রকাঠামোর গোড়ার সংকটে তেমন বদল হয়নি। এ ক্ষেত্রে সম্ভবত আমরা অনেকটাই ‘বদলে না যাওয়া’ বাংলাদেশ।

Monday, September 2, 2024

সংস্কার লগ্ন (Reform Window)



সংস্কার লগ্ন (Reform Window)

ড এম জসিম আলী চৌধুরী
প্রভাষক, আইন, ইউনিভার্সিটি অব হল, যুক্তরাজ্য

২৪ অগাস্ট ২০২৪ (ফেসবুক পোষ্ট)



বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক সাহেব একজন দাম্ভিক মানুষ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। সেটা শুধু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নয়। চার দলীয় জোট সরকারের ২০০১-২০০৬ মেয়াদেও সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে তিনি ট্রাফিক পুলিশের সালাম দেয়া না দেয়া সহ নানাবিধ ছোটখাট ব্যাপারে অতিরিক্ত একগুঁয়েমি দেখানো, অ-বিচারক সুলভ ও অশোভন আচার-আচরণ করেছেন। উনার আচরণ, কথাবার্তা এবং চলন-বলনের ভেতর প্রজ্ঞা, ধৈর্য, ভিন্নমত ধারণকারীকে প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়ার প্রবণতা বা এমনকি সমালোচকেরও শ্রদ্ধা অর্জনের মতো কোন কিছু চোখে পড়তো না। নিজের পেশাগত ও সামাজিক অবস্থানের তোয়াক্কা না করে তিনি আচরণ করতেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর একেবারে মাঠ পর্যায়ের গুন্ডাপান্ডা টাইপের লোকদের মতো করে।

সংবিধান নিয়ে পড়ালেখা করতে গিয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের দেয়া বিভিন্ন রায়গুলোতেও জুরিসপ্রুডেন্সিয়াল কোন ডেপথ আমি কখনো পাই নি (সেটি এমনিতেও আমাদের খুব বেশি রায়ে পাওয়া যায় না)। উনাকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে কোথাও রেফারও করি না।

তারপরও দুঃখ লাগছে, গ্রেফতার হওয়ার সময় হতে উনার সাথে আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আচরণ সহ আদালত প্রাঙ্গণে উনার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দেখে। গতকাল গ্রেফতার হওয়ার পর, উনার দুর্দশা ও লাঞ্ছনাকে অনেকেই "ন্যাচারাল জাস্টিস" বলছেন। হয়তো হতেও পারে। আল্লাহ্‌র বিচার নিয়ে আমি বান্দার বুঝ ব্যবস্থা সীমিত। এই "ন্যাচারাল জাস্টিস" থেকে কোন শিক্ষা হয়তো ক্ষমতার বলয়ে আসা-যাওয়া করতে থাকা মানুষরা কেউ নিতে পারেন (যদিও এমন শিক্ষা আমি আজ পর্যন্ত কাউকে নিতে দেখি নি)।


দুনিয়ার আদালতে আমরা যদি উনার সাথে উনার মতোই আচরণ করি, তাহলে উনার সাথে আমাদের পার্থক্য কি হল? উনাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়েছে বলে ধরে নিচ্ছি, আচরণগত ও রাজনৈতিক মতাদর্শ জনিত নিন্দাবাদ ছাড়া, উনার বিরুদ্ধে ঠিক কি ধরনের ফৌজদারি বা দেওয়ানি অভিযোগ আনা হবে সেটি এখনো চূড়ান্ত হয় নি। রাষ্ট্রের কাছে একজন দাগী অপরাধীরও নুন্যতম প্রাপ্য কিছু থাকে। অতীতের কর্দমাক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ভেঙ্গে চুরে প্রত্যাশিত বা প্রতিশ্রুত নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি আসলেই আমরা গড়তে চাই তাহলে এই 'আপাতত আগেরগুলোর শোধ তুলে নিই, সংস্কার পরে দেখা যাবে" মানসিকতাটা কোন শুভ সংকেত দেয় না।

হয়ত কেউ কেউ ভাবতে পারেন, রাজনৈতিক ভাবাদর্শে আমি আওয়ামী লীগ ঘরানার লোক বলে শুধুমাত্র শামসুদ্দিন মানিক সাহেবেরটা বেশি করে দেখছি। ব্যাপারটা আসলেই তেমনটি না। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নিয়ে আমার প্রকাশিতব্য বইটিতে আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি কিভাবে, কেন এবং কোন মানসিক ও সামাজিক ব্যধির চক্রে পড়ে আমাদের ৫৩ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে আসা পাঁচ-পাঁচটি সংস্কার লগ্ন (Reform Window) ব্যর্থ হয়ে গেছে এবং আমরা ঘুরে ফিরে সেই আগের পাক-চক্রে পড়ে থেকেছি। আমার বইয়ে আলোচিত পাঁচটি সংস্কার লগ্ন হচ্ছে - ১৯৭২ এ স্বাধীন দেশের যাত্রা শুরুর মুহূর্ত, ১৯৭৫ এর মধ্য অগাস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরের মুহূর্ত, ১৯৯০ এর গণ অভ্যুত্থান এর পর গণতন্ত্রের পথে নবযাত্রার মুহূর্ত, ২০০৭ এর ১/১১র পর মাইনাস টু ফর্মুলায় দুর্নীতিমুক্ত নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির আশা দেয়ার মুহূর্ত, এবং ২০০৯ এ ভুমিধ্বস বিজয় নিয়ে আওয়ামী লীগের নতুন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের মুহূর্ত।

দুঃখজনকভাবে প্রতিটি বাঁক বদলের মুহূর্তই চরম ব্যর্থতায় কালের গর্ভে হারিয়েছে। আশা করি ও দোয়া করি - এই ষষ্ট মুহূর্তটিও কালের গর্ভে না হারাক।

নতুন সংবিধান বিতর্ক: ১৯৭২ এর সংবিধানের “ত্রুটি”

নতুন সংবিধান বিতর্ক:  ১৯৭২ এর সংবিধানের “ত্রুটি” ড. এম জসিম আলী চৌধুরী  প্রভাষক আইন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব হাল, যুক্তরাজ্য  সিফাত তাসনীম আইন...