Friday, March 15, 2024




ল'ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ
সাক্ষাৎকার / মতামত ১০ মার্চ, ২০২৪


ড. এম জসিম আলী চৌধুরী
প্রভাষক, আইন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব হল, যুক্তরাজ্য।
ই-মেইল: j.chowdhury@hull.ac.uk





ভূমিকা

২০১৪ সালে বিচারপতি এ বি এম আলতাফ হোসেন এবং বিচারপতি ফরিদ আহমেদ শিবলী-কে স্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগ না দেয়াকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা মামলায় আপিল বিভাগের পূর্ণ রায় কয়েক দিন আগে প্রকাশিত হয়েছে। মামলাটির আদেশ হয়েছিলো ২০২৩ এর জুনে। পূর্ণ রায় এসেছে গত ২৮ ফেব্রয়ারি ২০২৪ (https://www.supremecourt.gov.bd/resources/documents/1099382_CA_NO-232_of_2014_Altaf_Hossain_Farid_Ahmed_Shibli.pdf)

রায়ের চূড়ান্ত আদেশের (বি) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে বিচারক নিয়োগ নিয়ে নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মতের পার্থক্য হলে কোন এক পক্ষের মতামত প্রাধান্য পাবে না। মহামান্য আপিল বিভাগের আদেশে আরো বলা হয়েছে, এ ধরণের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির কাছে ব্যাপারটা দ্বিতীয়বার পাঠানো হবে। দ্বিতীয়বারে প্রধান বিচারপতি যা বলবেন সেটি যথাযথ বিবেচনা করা হবে বলে আদালত আশা করেন (চূড়ান্ত আদেশের (ই) অনুচ্ছেদ)। এ প্রস্তাবনাটি কৌতহল উদ্দীপক। কারণ এটি উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ সম্পর্কে আমাদের (ভারত এবং পাকিস্তানেরও) সর্বোচ্চ আদালতের গত বিশ-ত্রিশ বছরের রায়ের ধারার বিপরীত।

এই বিশ-ত্রিশ বছরে ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতকে আমরা বিচারক নিয়োগ প্রশ্নে প্রধান বিচারপতির মতের প্রাধান্যের বাইরে কিছুই মেনে নিতে দেখিনি। দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ আদালতগুলো এটাকেই সংবিধান, সংবিধানের ব্যাসিক স্ট্রাকচার এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার একমাত্র গ্যারান্টি বলে এসেছেন এবং বলে চলেছেন। এটি নিয়ে উপমহাদেশের আইনের অধ্যাপকদের অনেকেই চাঁছাছোলা সমালোচনা করে থাকেন।

এই মামলার বিশেষত্ব হচ্ছে এখানে বাদ দেয়া দুই বিচারপতি নিয়োগের যোগ্যতার পূর্বশর্ত (যেমন, ১০ বছর হাইকোর্ট প্রাকটিস) পূরণ করেন নি বলে যুক্তি এসেছিল। আপিল বিভাগও সংশ্লিষ্ট বিচারকদের এন্টিসিডেন্ট বা যোগ্যতার শর্ত পুরনের প্রশ্নে মতবিরোধ নিয়ে বলেছেন। জুডিশিয়াল একুমেন (বিজ্ঞতা) নিয়ে মতবিরোধের কথা বলেন নি। সুতরাং একটা ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ থাকে যে, জুডিশিয়াল একুমেন প্রশ্নে বাংলাদেশের আপিল বিভাগ হয়ত এখনো আগের মতোই প্রধান বিচারপতির মতামতের প্রাধান্যের অবস্থানে আছেন।



দুটি বিনীত সমালোচনা

একাডেমিক বিবেচনায় আমি (এবং আমার মতো আরো অনেকেই) বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতি ও উনার কলিজিয়ামের একচ্ছত্র আধিপত্য ও শেষ কথা বলার অধিকারের পক্ষে নই। সেদিক থেকে এ রায়টা অনেকেরই সমর্থন পাওয়ার কথা। কিন্তু একটা ভালো রায় লেখার মতো বিশদ গবেষণাধর্মী ও শ্রমসাধ্য কাজের পেছনে মাননীয় বিচারপতিদের যে ধরণের গভীর ও মানসম্মত গবেষণা সহায়তা পাওয়ার কথা সে ধরণের সহায়তা তাঁরা এ মামলার ক্ষেত্রে পান নি বলেই আমার মনে হয়েছে। মহামান্য আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের রায়ের কয়েকটি জায়গা থেকে দুটি উদাহরণ দিচ্ছি।
১.

মতামতের প্রাধান্যের প্রশ্নে মাননীয় বিচারপতি (বর্তমানে বাংলাদেশের মহামান্য প্রধান বিচারপতি) ওবায়দুল হাসানের সিদ্ধান্তটি অনেকটাই ভারতীয় এস পি গুপ্তা মামলার রায়ের উপর ভিত্তি করে নেয়া (পূর্ণ রায়ের ৫২-৫৭ পৃষ্ঠা দেখুন) বলে প্রতীয়মান হয়। ১৯৮২ সালের এ রায়ে ভারতীয় বিচারপতি ভগবতির মূল কথা ছিলো, বিচারক নিয়োগের সুপারিশ প্রশ্নে প্রধান বিচারপতির মত গুরুত্বপূর্ণ তবে শেষ কথা নয়। রায়টি তৎকালীন ভারত সরকারের একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে মাত্র ৪-৩ মেজরিটিতে দেয়া হয়েছিল। পরে ১৯৯৩ সালে সেকেন্ড জাজেস কেইস (Supreme Court Advocates-on-Record Association v Union of India (1993) 4 SCC 441) এর বিচারপতিরা এস পি গুপ্তার রায়টি বাতিল করে দেন।

তখন বলা হয়, প্রধান বিচারপতির সুপারিশ মানা বাধ্যতামূলক। পরে থার্ড জাজেস কেইস (Re Special Reference No 1 of 1998 (1998) 7 SCC 739) এ আবারো বলা হয় প্রধান বিচারপতি ও উনার কলিজিয়ামের সুপারিশ মানা বাধ্যতামূলক। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ভারতীয় বিচারক নিয়োগ কমিশন মামলায় (Supreme Court Advocates-on-Record Association v. Union of India (2016) 5 SCC 1) এ কথাটা আবারো একেবারে বেদ বাক্যের মত করে বলা হয়।

একই কাজ পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট করেছেন ১৯৯৬ সালের আল জিহাদ ট্রাস্ট, ২০১০ সালের নাদিম আহমেদ (১৮ তম সংশোধনী) ও ২০১১ সালের মুনির হোসেন ভাট্টি (১৯ তম সংশোধনী) মামলায়। আমাদের মাহামান্য আপিল বিভাগও এ কাজ করেছেন মাসদার হোসেন ও ১৬তম সংশোধনী (Advocate Asaduzzaman Siddiqui v. Bangladesh10 ALR (AD) 03) মামলা সহ আরো অনেক মামলায়।

এখন এতগুলো ধারাবাহিক রায়ের বিপরীতে কথা বলতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই ওই রায়গুলোর অস্তিত্ব স্বীকার করে ওগুলোকে খণ্ডন করেই বলতে হবে। আমাদের বলতে হবে ওই মামলাগুলোর প্রেক্ষাপট ও প্রাসঙ্গিকতা কেন এখানে নেই। আমাদের আরো বলতে হবে কেন আমরা এস পি গুপ্তার কাছেই ফিরে যাবো। ওই মামলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট (যেটি আগে বলেছি) এবং ঘটনা (বিচারকের বদলি)-র বিবেচনায় কারো কারো কাছে এস পি গুপ্তা মামলাটি এ মামলার জন্য কিছুটা দূরবর্তী মনে হতে পারে। কিন্তু মহামান্য আদালতের গবেষণা সহায়তায় যারা ছিলেন তাঁরা এ ব্যাপারটি উপেক্ষা করেছেন বলেই মনে হয়েছে। এমতাবস্থায় এস পি গুপ্তা-র বাতিল হয়ে যাওয়া রায়টি থেকে দেয়া পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠার রেফারেন্স আমাদের মহামান্য আপিল বিভাগের যুগান্তকরি এ রায়টির যুক্তির আবদেনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
২.

মহামান্য আদালতের রায়ের একটি অংশে (৭১-৭৪ পৃষ্ঠা দেখুন) মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদালতের কাছে জবাবদিহিতা না করার ব্যাপারটি কিছুটা আক্ষরিক অর্থে পাঠ করা হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হতে পারে। বিশেষত রায়ের ৭৪ পৃষ্ঠায় সংবিধানের ৪৮(৩) ও ৫১ অনুচ্ছেদ মিলিয়ে আদালতের কাছে মহামান্য রাষ্ট্রপতির জবাব দিতে না হওয়ার ব্যাপারটি যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে সেটি আমাদের উচ্চ আদালতের পূর্বতন রায়গুলোর সাথে কিছুটা সাংঘর্ষিক। যেমন, ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে ১০ অতিরিক্ত বিচারপতিদের একটি মামলাতেই (Govt. of Bangladesh v. M. Shamsul Huda & ors 60 DLR (AD) 124) সরকার দাবি করেছিলো রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রী কি পরামর্শ দেন সেটি আদালত দেখতে চাইতে পারেন না। মহামান্য আপিল বিভাগ মানেন নি। বরং বলেছেন রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রী কি পরামর্শ দিয়েছেন সেটি দেখতে না পারলেও প্রধানমন্ত্রী যে দলিলের ভিত্তিতে পরামর্শ দিয়েছেন সেটি আমরা দেখতে চাইতে পারি (ওই মামলার প্যারাগ্রাফ ১৯)।

একইভাবে ৫১ অনুচ্ছেদ নিয়েও আদালতের ঐতিহাসিক অবস্থান এ রায়ের কিছুটা বিপরীত। উচ্চ আদালত খন্দকার মোশতাক ও হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদের বিভিন্ন ব্যক্তিগত কার্যকলাপ চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা কিছু মামলায় রাষ্ট্রপতির ইমিউনিটিকে সীমিত করে দেখেছেন, শর্তহীন বলেন নি। তাছাড়া আদালত ঐতিহাসিকভাবেই রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা ও বিবেচনাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। ১৯৯০ এর দশক থেকে আমরা জেনে এসেছি, আমাদের আদালত এ সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সাবজেকটিভ সেটিস্পেকশনের দাবি মানেন না। সবসময়ই অবজেক্টিভ সেটিস্পেকশনের পক্ষে অবস্থান নেন। এটি আমাদের একটি প্রতিষ্ঠিত ডকট্রিন। এমন কি ২০০৭-২০০৮ সালের জরুরি অবস্থার শেষের দিকে তখনকার অত্যন্ত ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদের জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত বিভিন্ন ক্ষমতা চর্চাকে আদালত অবলীলায় প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। বিশেষত ওই সময়ের বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তাঁর বিভিন্ন রায়গুলোতে বাংলদেশ একচেটিয়া রাষ্ট্রপতিতন্ত্র নয় বলেই মত দেন। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার সীমিত পাঠ সংসদীয় গণতন্ত্র এবং সাংবিধানিক জবাবদিহিতারও দাবি।

মাননীয় প্রধান বিচারপতি-র রায়টিতে কিছুটা অস্বস্তিকর আরেকটি ব্যাপার হলো সংবিধানিক আইনের উপর প্রতিষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ নন এমন একজন একেবারে অখ্যাত নবীন ছাত্রের একটি অখ্যাত ওয়েবসাইটে দেয়া ব্লগ পোষ্টকে রায়ের চার্ পৃষ্ঠা জুড়ে উল্লেখ করা (পূর্ণ রায়ের ৫৮-৬২ পৃষ্ঠা দেখুন)। স্পষ্টতই http://www.mazellaws.com নামের ওই ওয়েবসাইটটি কোন একাডেমিক পিয়ার রিভিউ করা মানসম্পন্ন জার্নাল প্রকাশ করে না। এটি একটি সাধারণ তথ্যভান্ডার যেটি পরিচালনা করেন “a group of enthusiastic individuals who want to voice their opinions and channel their inner intellect on a plethora of matters”. খুব সম্ভবত মহামান্য আদালতের গবেষণা দলের অসতর্কতায় আলোচ্য ব্লগটি প্রসঙ্গে রায়ে বলা হয়েছে , “Recently an Article has been published in a foreign law journal namely, ‘Mazellaws Digest’” (পূর্ণ রায়ের ৫৮-৬২ পৃষ্ঠা দেখুন)।

এটি একটি অতি সাধারণ কোন ধরণের রেফারেন্সবিহীন ব্লগ পোষ্ট হলেও, যেহেতু আদালতের রায়ে এসেছে সেহেতু আমি লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। সাংবিধানিক আইনে আলোচ্য লেখকের বোঝাপড়া একেবারে ন্যূনতম পর্যায়ের বলেই প্রতীয়মান হয় যখন তিনি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে প্রায় জবাবদিহিতার উর্ধে প্রমাণ করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতির বিচারক নিয়োগের দাফতরিক কাজের সাথে অসদাচরণের দায়ে সংসদ কর্তৃক রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করার প্রক্রিয়াকে গুলিয়ে ফেলেন। সংবিধানের ৫২(২) অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়ে উক্ত লেখক দাবি করেন, রাষ্ট্রপতির কোন আচরণ আদালতের কাছে বা ও অন্য কোথাও রেফার করার ক্ষমতা কেবলমাত্র সংসদের। সন্দেহ নেই, এ যুক্তিটি একেবারে বালখিল্যতাপূর্ণ এবং সারবত্তাহীন। ৫২ অনুচ্ছেদ মহামান্য রাষ্ট্রপতির বাক্তিগত আচরণজনিত কারণে সৃষ্ট সংসদীয় অভিশংসন প্রক্রিয়া। এখন এই নবীন লেখক যদি বলতে চান, কেবল মাত্র ৫২ অনুচ্ছেদের সংসদীয় অভিসংশন প্রক্রিয়ায় ছাড়া মহামান্য রাষ্ট্রপতির আর কোন কিছুই কেউ আদালতের প্রেরণ করতে পারবেন না, তাহলে রাষ্ট্র বা সরকারের কোন কাজই বা রষ্ট্রপতির কোন বিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্তই আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। কারণ সংবিধানের ৫৫(৪) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রের সব কাজই রাষ্ট্রপতির নামে এবং অনুমোদনে করতে হয়। বিচারক নিয়োগের প্রশ্নে বা অধ্যাদেশ জারির প্রশ্নে বা যে কোন সাংবিধানিক ও দাফতরিক কাজ ও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক রাষ্ট্ৰপতির (প্ৰকৃতপক্ষে সরকারের তথা রাষ্ট্রের) বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার রাখেন। সংবিধানের ৪৪ ও ১০২ অনুচ্ছেদের মূল কথা এটা।

অন্যদিকে ৫১ অনুচ্ছেদ মহামান্য রাষ্ট্রপতি-র বাক্তিগত দায়মুক্তি প্রসঙ্গে। এটি উনার দাফতরিক জবাবদিহিতা থেকে দায়মুক্তি নয়। ৫২ অনুচ্ছেদ মহামান্য রাষ্ট্রপতির বাক্তিগত আচরণজনিত কারণে সৃষ্ঠ সংসদীয় অভিশংসন প্রক্রিয়া। এগুলোর সাথে রাষ্ট্রের দাফতরিক কাজকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে করা রিট মামলাকে গুলিয়ে ফেলা যায় না। তাছাড়া ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ নিয়ে মহামান্য আপিল বিভাগের আরেকটি বিপরীতধর্মী রায় আমি আগের প্যারাফগ্রাফেই উল্লেখ করেছি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, State v. Abdul Khaleque 49 DLR (AD) (1997) 154 মামলায় মহামান্য আপিল বিভাগ অখ্যাত প্রকাশনার অখ্যাত লেখকের ছোট একটি বই রেফারেন্স হিসেবে গ্রহন করতে অস্বীকার করেন এই বলে যে, “It is a tiny booklet perhaps meant for busy trial lawyers dealing with various subjects relating to criminal trial gandoisely dedicated to “New Swimmers of Occans of Law.”

সবশেষে উল্লেখ্য যে, এস পি গুপ্ত মামলা ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা-র বিচারিক নিরীক্ষা প্রসঙ্গে এই মূল্যায়নের বক্তব্যগুলোর জোরালো সমর্থন বিচারপতি বোরহান উদ্দিন এবং বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম এর রায়ে পাওয়া যায় (পূর্ণ রায়ের ৯৫, ৯৯ এবং ১০১-১০৮ পৃষ্ঠা দেখুন) ।



রায়ের সুদূর প্রসারী সম্ভাবনা

রায়টি পুরো পড়ে আমার মনে হয়েছে এটি আসলে ১০ অতিরিক্ত বিচারপতির মামলায় (Bangladesh & Justice Syed Dastagir Hossain v. Idrisur Rahman 15 BLC (AD) 49) এন্টিসিডেন্ট বা যোগ্যতার শর্ত পূরণের প্রশ্ন এবং জুডিশিয়াল একুমেন (বিজ্ঞতা) এর প্রশ্নে যে পার্থক্য করা হয়েছে তার উপর। আমার জানামতে ওই মামলায় ১০ বিচারপতির যোগ্যতার শর্ত নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠে নি। প্রকৃতপক্ষে ওই সময় চার্ দলীয় জোট সরকার আদালতকে বলেননি তারা কি বিবেচনায় ১০ বিচারপতিকে বাদ দিয়েছিলেন। ফলে সুপ্রিম কোর্টকে বলতে হয়েছে বিবেচনা জুডিশিয়াল একুমেন হলে প্রধান বিচারপতির মতামত প্রাধান্য পাবে (ডোমিনেন্ট হবে)। বিবেচনা চাকুরীর যোগ্যতার শর্ত পূরণ হলে হয়তো প্রধান বিচারপতির মতামত ডরমেন্ট হবে। এটি ছিলো একটি দৃশ্যকল্প। ওই মামলার ঘটনা নয়। এবারে এটি মামলার ঘটনা। সুতরাং মহামান্য প্রধান বিচারপতির রায়ের একটি অংশে যথাযথভাবেই (৬৩-৬৮ পৃষ্ঠা দেখুন) এটির উপর আলোকপাত করা হয়েছে। মাননীয় বিচারপতি মোঃ নুরুজ্জামান এর রায়েও আমরা এর দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত কিছু ইঙ্গিত পেয়েছি (রায়ের ১৬-১৭ পৃষ্ঠা দেখুন)। রায়ের অন্যান্য অংশেও এটি ভালোভাবে এসেছে। আমার মনে হয় এ মামলার জুরিসপ্রুডেনসিয়াল কন্ট্রিবিউশন এখানে এবং এ অংশটুকু ভবিষ্যতে অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় আদালতগুলোকে পথ দেখলে অবাক হবো না। আমি অদূর ভবিষ্যতে এ ধারণাটি নিয়ে আরো গবেষণা করতে চাই।

(ঋণ স্বীকার: সম্প্রতি প্রকাশিত রায়টি আমার নজরে আনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবী মোকাররামুছ সাকলানের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। রায়ের শ্রদ্ধাপূর্ণ একাডেমিক সমালোচনা ও অন্যান্য মতামত একান্তই আমার।)

Friday, February 23, 2024




Dr M Jashim Ali Chowdhury

The Daily Star, Law and Our Rights, 23 February 2024

My opinion (written in Bangla) on the debate regarding the oath of the newly elected MPs of Bangladesh was published on 29 January 2024 on the site of Lawyers Club Bangladesh. I actually wrote the text first in English. The English version was published today on the Law and Our Rights page of the Daily Star, the leading English daily in Bangladesh. Law and Our Rights edited a couple of sentences and words. I really liked the editing, especially the word "Conundrum" in the title. If you are interested in the oath debate, please click the link below:

https://www.thedailystar.net/law-our-rights/news/oaths-the-mps-constitutional-conundrum-3550686?fbclid=IwAR17cyZ5gGCPseskj4NL4XQy4AzxEYnB7lBF9Lgi6axw4kmX9DmlGcoJkYQ 




Thursday, February 1, 2024


নতুন সাংসদদের শপথ নিয়ে সাংবিধানিক জটিলতার সমাধান সূত্র


ড এম জসিম আলী চৌধুরী

প্রভাষক, আইন, ইউনিভার্সিটি অফ হল, যুক্তরাজ্য।

ইমেইল: j.chowdhury@hull.ac.uk

লেখাটি ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে ল'ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশের অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত হয়



নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ নিয়ে একটি সাংবিধানিক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এই শপথ গ্রহণ আক্ষরিক অর্থে সাংবিধানিক হতে পারে। তবে এ নিয়ে আর কিছু সোজাসাপ্টা প্রশ্নের উত্তরও আমাদের খুঁজতে হবে। 


একটি আক্ষরিক পাঠ

অনুচ্ছেদ ১২৩(৩)(ক) অনুযায়ী আগের সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। সেই তিন মাসের মধ্যেই গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।  অনুচ্ছেদ ১৪৮(২ক)-তে বলা হয়েছে নির্বাচনের ফলাফল গেজেট করার তিন দিনের মধ্যে শপথ গ্রহণ করতে হবে। এ বিধানটি ২০০৪ সালে চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিএনপি সরকার কর্তৃক ঢোকানো হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ৩৯(৪)-তে নির্বাচন কমিশনের গেজেট প্রকাশের জন্য ন্যূনতম বা সর্বোচ্চ সময়সীমা উল্লেখ নেই। কমিশন গেজেট প্রকাশ করলে স্পিকার তিন দিনের মধ্যে শপথ পড়াতে বাধ্য।

অনুচ্ছেদ ১৪৮(৩) বলছে এমপি-রা শপথ নেওয়ার পর “অবিলম্বে” (“immediately”) কার্যভার গ্রহণ করবেন। অন্যদিকে অনুচ্ছেদ ১২৩(খ) খুব স্পষ্টভাবে বলে যে, নবনির্বাচিত এমপি-রা আগের সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে দ্বায়িত্ব নেবেন। একাদশ সংসদের মেয়াদ এ বছরের ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, অনুচ্ছেদ ১৪৮(৩)-র নিয়মটি অন্য সকল শপথ গ্রহণকারী পদাধিকারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও এমপিদের জন্য হবে না। কারণ ১২৩(খ) অনুচ্ছেদে তাঁদের জন্য আলাদা নিয়ম আছে। আইন ব্যাখ্যার নিয়ম হলো, সাধারণ নিয়মের উপর নির্দিষ্ট নিয়ম প্রাধান্য পাবে। তবে ব্যাখ্যার এ নিয়ম দিয়েও সমস্যার শেষ হচ্ছে না। সংবিধানের তৃতীয় তফসিলে এমপিদের জন্য দেয়া শপথে একটি অতিরিক্ত ঝামেলা আছে। 

শপথে বলা আছে, সংসদ সদস্য তাঁর "দায়িত্ব গ্রহণ করিতে যাইতেছেন" (“about to enter”)। "করিতে যাইতেছেন" (“about to enter”) কথাটা-র দুই অর্থ হতে পারে। প্রথমত, এটি একটি তাৎক্ষণিক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিতে পারে। আমরা বলতে পারি যে, এমপি-রা তাঁদের শপথ নেওয়ার পর "অবিলম্বে" (“immediately”) অফিসে প্রবেশ করছেন। এই অর্থটি অনুচ্ছেদ ১৪৮(৩) এর সাথে যায়। দ্বিতীয়ত, সাধারণ ধারণায় "করিতে যাইতেছেন" (“about to enter”) কথাটা  কাছের, কিন্তু বেশি দূরের না এমন, ভবিষ্যতেরও ইঙ্গিত দিতে পারে। আমরা এটাও বলতে পারি যে, "করিতে যাইতেছেন" (“about to enter”) এর অর্থ অদূর ভবিষ্যতে তাঁদের দায়িত্ব নেয়া। এ অর্থটি ১২৩(খ) অনুচ্ছেদের সাথে মানান সই। ১২৩(খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তাদের ২৯ জানুয়ারী ২০২৪ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাহলে প্রশ্ন হলো, “about to enter” এর দুই অর্থের মধ্যে কোনটি আমরা নেবো? সঙ্গত কারণেই আমাদের ওই অর্থটি নিতে হবে যেটি নির্দিষ্ট বিধানটির সাথে মিলে। এটি সাধারণ বিধানের সাথে মিলে যাওয়া অর্থটির উপর প্রাধান্য পাবে।

দেখা যাচ্ছে, সংবিধানের আক্ষরিক পাঠে হয়তো ১১ জানুয়ারির শপথটি টিকে যাবে। তারপরও আরেকটি প্রশ্ন থেকে যায়।


Parliament Speaker Shirin Sharmin Chaudhury administers the oath of office to the newly elected Awami League lawmakers on Wednesday, January 11, 2024. Photo: Bangladesh Prime Minister's Office


একটি বিবেক তাড়িত  প্রশ্ন

১১ জানুয়ারী ২০২৪ থেকেই কি নবনির্বাচিত এমপিদের বেতন-ভাতা শুরু হয়েছে? আমি সংসদ সদস্য (বেতন ও ভাতা) আদেশ ১৯৭৩ দেখার চেষ্টা করেছি। ধারা ২(ঘ) বলছে এমপিদের অফিসের মেয়াদ তারা যেদিন তাঁদের চাকরিতে প্রবেশ করে সেদিন থেকে শুরু হয় এবং তাঁদের মেয়াদ শেষ হওয়ার দিনে শেষ হয়। যদি উপরে উল্লিখিত আক্ষরিক ব্যাখ্যা ধরে আমরা বলি যে নতুন শপথ নেয়া সংসদ সদস্যরা একাদশ সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত  দ্বায়িত্বে প্রবেশ করবেন না, সেক্ষেত্রে ২৯ জানুয়ারির আগে তাঁদের বেতন ভাতা শুরু হওয়া উচিত নয়। প্রশ্ন হলো, দশম ও একাদশ সংসদের শুরুতে কি এটি মানা হয়েছিল? আমি মনে করি বাংলাদেশের জনগণ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার হকদার ।

 

একটি সাংবিধানিক অস্বাভাবিকতা

শপথ নিয়ে জটিলতার এ পুরো ব্যাপারটিতে আমাদের একটি সাংবিধানিক অস্বাভাবিকতা (anomaly) আছে। প্রশ্ন করি, ১১ জানুয়ারি সংসদ সদস্যদের এত তাড়াতাড়ি করে শপথ নেওয়ার কী দরকার ছিল? এটি করতে হয়েছে দুটি কারণে। প্রথমত, একটি পদ্ধতিগত সাংবিধানিক রীতি (procedural convention) যা আমরা অতীতে তৈরি করেছি এবং দ্বিতীয়ত, ২০০৪ সালের বিতর্কিত সাংবিধানিক সংশোধনী যা আমাদের বর্তমান বাস্তবতার সাথে খাপ খায় না।


একটি পদ্ধতিগত সাংবিধানিক রীতি 

আমরা দেখে আসছি আমাদের দেশে নির্বাচনের পর সাংসদরা শপথ নেন, দলগুলি তাঁদের সংসদীয় দলের সভা ডাকে, নেতা নির্বাচন করে এবং তারপর মেজিরিটি পার্টির নেতাকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। আমরা যদি এটিকে একটি পদ্ধতিগত সাংবিধানিক রীতি (procedural convention) বলতে চাই তবে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ এ প্রথাটি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাথে বেশি খাপ খায়। তখন নির্বাচনের আগে পূর্ববর্তী সংসদগুলি ভেঙে দেওয়া হতো। রাষ্ট্রপতি নতুন সংসদ সদস্যদের শপথ নেয়া এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে নেতা নির্বাচন করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু এখন  আগের সংসদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে নির্বাচন হয়। আগের সংসদ বিলুপ্তও হয় না। এখন প্রধানমন্ত্রী কে হবেন সেটা জানার জন্য সংসদ সদস্যদের শপথ নেয়া এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নেতা নির্বাচন করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে দেখা যাচ্ছে, দেশে দুইটি সংসদ সৃষ্টি হয়ে বসে থাকছে। সুতরাং প্রশ্ন হলো, বর্তমান ব্যবস্থার সাথে পদ্ধতিগত সাংবিধানিক রীতিটি কি মানায়? সম্ভবত না। বর্তমানে এটির আসলে দরকারও নেই।  


Bangladeshi President Mohammed Shahabuddin administers Prime Minister Sheikh Hasina's oath-taking ceremony as the country's Prime Minister in Dhaka, Bangladesh. (Reuters)

আমার বিবেচনায় অনুচ্ছেদ ৫৩(৩) এবং(৪)-তে এমন কিছু নেই যেটি নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের আগে রাষ্ট্রপতিকে সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ এবং নতুন সংসদ অধিবেশনে বসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলছে। শুনতে কিছুটা অস্বাভাবিক লাগলেও এটা সত্য। ৫৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে  রাষ্ট্রপতি এমন একজনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন যিনি তাঁর বিবেচনায় (who “appears to him”) সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপিদের সমর্থনপুষ্ট। ঐতিহাসিকভাবে, ভারতীয় রাষ্ট্রপতিরা নির্বাচনের ফলাফল স্পষ্ট হওয়ার পরপরই, নতুন সংসদের আনুষ্ঠানিকভাবে আহবান করার এবং সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার আগেই, প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছেন। এটি মৌন সংসদীয় সমর্থন (negative parliamentary investiture) হিসাবে পরিচিত। ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোটের নেতার উপর সংসদের আস্থা আছে বলে ধরে নেওয়া হয় যতক্ষণ না সংসদ অনাস্থা ভোট পাশ করে। সন্দেহ থাকলেও রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। তারপর তাঁদেরকে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে বলেন। ভারতীয় রাষ্ট্রপতিরা তাঁদের সংবিধানে স্পষ্ট কোন বিধান না থাকা স্বত্তেও কাজটি করেন। বিবেচনা প্রসূত ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।  আমাদের রাষ্ট্রপতির কাছে বরং “appears to him”-এর মতো সাংবিধানিক ক্ষমতা আছে। দ্বিতীয়ত, অনুচ্ছেদ ৫৬(৩) এবং ৫৭(৩) একসাথে মিলিয়ে পড়লে দেখা যাবে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে প্রবেশ এবং মেয়াদ পূর্তি সংসদের শুরু বা মেয়াদের উপর নির্ভর করে না। রাষ্ট্রপতি সংসদ ডাকার আগে প্রধান মন্ত্রী নিয়োগ দিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর নতুন প্রধান মন্ত্রীর শপথ না নেয়া পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারেন।   


একটি বিতর্কিত সংবিধান সংশোধনী

২০০৪ সালের চতুর্দশ সংশোধনী গেজেটের তিন দিনের মধ্যে শপথ নেওয়া বাধ্যতামূলক করে তোলে। ঠিক কী ধরণের সাংবিধানিক জরুরত বিএনপি সরকারকে এই পরিবর্তন করতে প্ররোচিত করেছিল তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ধারণা করতে পারি, ২০০৬ এর শেষের দিকে অনুষ্টিতব্য পরবর্তী সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে তাঁদের হয়ত কিছু উদ্বেগ ছিল এবং ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তাঁদের সাজানো তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনোভাবে সে নির্বাচনটি করে ফেলতে পারলে সরকার গঠনে তারা হয়ত বেশি দেরি করতেন না। যা-ই হোক, নতুন ব্যবস্থার সাথে বেমানান হয়ে পড়লেও বিধানটি এখনো আছে।


দুটি সম্ভাব্য সমাধান

প্রথমত, ২০০৪ সালের সংশোধনী বর্তমান ব্যবস্থার জন্য আর উপযুক্ত নয় যেখানে সংসদ কখনও বিলুপ্ত হয় না। এটা বাদ দিয়ে দেয়াই সঙ্গত। দ্বিতীয আরেকটি বিকল্প হতে পারে যে, নতুন সংসদ সদস্যরা শপথ নেওয়ার মুহূর্ত থেকে রাষ্ট্রপতি আগের সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। 

কেউ কেউ বলেন, আগের সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার তিন মাস আগে তফসিল ঘোষণার পর সংসদ ভেঙে দেয়ার সুযোগ নেই। তবে আমার  মতে, ৫৭(২), ৭২(৩) এবং ১২৩(৩) অনুচ্ছেদে এমন কিছু নেই যা একজন প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতিকে যেকোনো সময় সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দিতে নিষেধ করে। অবশ্য এখানে একটা ঝুঁকি আছে। ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী এবং দলীয় রাষ্ট্রপতি ভোটের মাঠের অবস্থা খারাপ দেখলে ইতোমধ্যে তফসিল হয়ে যাওয়া নির্বাচনের আগ মুহূর্তে সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। এর ফলে ১২৩(৩)(খ) অনুচ্ছেদের সুযোগ নিয়ে তারা নির্বাচন আরো তিন মাস পিছিয়ে দিতে পারেন। 

এটি অনেকটা কোন প্রধানমন্ত্রী সংসদের আস্থা হারানোর পর পদত্যাগ না করে বরং রাষ্ট্রপতিকে সংসদই ভেঙে দিতে বলার মতো অবস্থা। সৌভাগ্যবশত, অনুচ্ছেদ ৫৭(২)-তে এ সমস্যার সমাধান আছে। বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি এ পরামর্শটি তাৎক্ষণিক গ্রহণ করবেন না। বরং সংসদ ভেঙে না দিয়ে দেখবেন আর কেউ মেজরিটির সমর্থন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন কিনা। একই যুক্তিতে, আমরা এখানেও বলতে পারি যে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর এই নির্বাচনপূর্ব পরামর্শকেও উপেক্ষা করতে পারেন। এটি রাষ্ট্রপতির বিবেচনা প্রসূত ক্ষমতা (discretionary power)। তবে আরও ভাল ব্যবস্থা হিসেবে আমরা সংবিধান সংশোধন করে অনুচ্ছেদ ৫৭(২) এর মতো একটা বিধান ১২৩(৩) অনুচ্ছেদেও যোগ করতে পারি। নির্বাচনপূর্ব ঝুঁকি প্রশমনের এ ব্যবস্থা রেখে, একটি নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে এবং একটি নতুন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল জানা গেলে আগের সংসদটি ভেঙে দিতে কোন সমস্যা দেখি না। 

১১ জানুয়ারি শপথ নেয়ার মুহূর্ত থেকে একাদশ সংসদকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিলুপ্ত ঘোষণা করতে পারতেন। তাহলে এ বিতর্কটি হয়তো আসতো না।  

Tuesday, January 16, 2024


Protecting Secularism in Bangladesh:

A Critique of the Constitutional Unamendability Approach

 
 

Dr M Jashim Ali Chowdhury*

Md Abdullah Al Mamun**

Md. Jahedul Islam***


Published in:

Rajshahi University Law Journal, Vol 11 (2023), 108-131

Full text available at: 

https://www.academia.edu/113587820/Protecting_Secularism_in_Bangladesh_A_Critique_of_the_Constitutional_Unamendability_Approach 


 


Abstract

Bangladesh’s struggle with religious fundamentalism is persistent. The liberal political force that spearheaded the country’s liberation war in 1971 tried to adopt a hard secularist policy by banning the religion-based political parties. However, the newly independent nation soon faced conservative and Islamist upsurge. In late 1970s, secularism was omitted from the constitution, and Islam was officially endorsed as the State Religion. In 2011, the current secularist regime revived Secularism. It, however, failed to remove the State Religion clause. The ban on religion-based political parties also could not be revived to its original extent. Still, they tried to entrench and better protect the compromised version of Secularism by inserting an ‘eternity clause’ in the Constitution. The eternity clause inserted through the Fifteenth Amendment Act 2011 made a large part of the Constitution, including the principle of Secularism, totally unamendable by any future parliament. This paper examines whether this ultimately saves the future of Secularism. It argues that textual entrenchment in the form of total unamendability may not prevent what the American constitutional experts call the ‘informal’, ‘off text’ or ‘stealth’ amendments. It further argues that the judicial protection through the implicit unamendability of ‘basic structures’ may also not be adequate to safeguard the Secularism against any its future dismemberment.

 

Keywords: Secularism, Constitutional Unamendability, Unconstitutional Constitutional Amendment, Basic Structure Doctrine, Judicial Review, Informal Constitutional Amendment, State Religion, Religion-based Politics.

 



* Lecturer, Law School, University of Hull, United Kingdom; Email: J.Chowdhury@hull.ac.uk

** Associate Professor, Department of Law, University of Chittagong; Email: mamunlaw1977@yahoo.com

*** Lecturer, Department of Law, Southern University Bangladesh; Email: mdjahedulislam59@gmail.com




Monday, November 27, 2023

বাংলাদেশের নির্বাচন সংকট ও সমাধান চিন্তা

 বাংলাদেশের নির্বাচন সংকট সমাধান চিন্তা

 

এম জসিম আলী চৌধুরী

প্রভাষক, আইন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব হল, যুক্তরাজ্য

-মেইল: J.Chowdhury@hull.ac.uk


সন্দেহ নেই আমরা আরেকটি একতরফা নির্বাচনের দিকে আগাচ্ছি। ২০১৪ হতে প্রতিটি এক তরফা নির্বাচনের কৌশল ভিন্ন ভিন্ন।  

২০১৪ সালে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতার নির্বাচন করে সরকারি দল বিরোধীদলের ভয়াবহ প্রতিরোধের ক্ষেত্র কমিয়ে দিয়েছিলো। এর ফলে সরকারি পুলিশ ও প্রশাসনের চাপ অর্ধেক কমে যায়। এটি ছিল কার্যত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তৎকালীন সরকারি দলের সারা দেশে এক তরফা নির্বাচন করতে না পারার "ভুল" থেকে নেয়া "শিক্ষা"। 


Photo Source: https://www.aa.com.tr/en/asia-pacific/1-dead-in-bangladesh-local-government-election-violence/2144731 

২০১৮ সালে ছিল ২০১৪ সালে বিএনপি "অংশ না নিয়ে ভুল করেছে" এমন জিগিরের উপর চালিয়ে নেয়া। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরটা দেশে ছিলাম। সারা মাসে বিরোধী দলকে ফেসবুক ও পত্রিকায় ছাড়া মাঠের কোথাও দেখি নি। পুলিশি চাপ ছিলো। আগের পাঁচ বছরে বিরোধী দলের ব্যাপক শক্তিক্ষয়ও ছিল লক্ষণীয়। মনে হচ্ছিলো সরকারি দল জিতবে। তারপরও তারা রিস্ক নেন নি। আগের রাতে ব্যালট ভরে যায়। ভোটের দিন সকাল ১১টা-র ভেতর সব কেন্দ্র দখল হয়ে যায়।

২০২৪ সালে এরকম হবে না। বিরধীদের ২০১৪ মত অবস্থা নেই। সুতরাং আইন শৃঙ্খলা নিয়ে অত চাপ নেয়ারও কিছু নেই। প্রায় সব আসনে দলের নির্ধারিত প্রার্থীর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাখা হবে। সমঝোতায় বিরোধী দলকেও কিছু আসন ছাড়া হবে। মোটামুটি প্রতিদ্বন্ধিতা থাকবে। হানাহানি যেন অতিরিক্ত না হয় (যেমনটি ইউ পি নির্বাচনগুলোতে হয়েছিল) সেদিকে খেয়াল রাখা হবে । মডেলটি ইতোমধ্যে বেশ কিছু সিটি কর্পোরেশনে পরীক্ষা করে ফেলা হয়েছে। এটি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষত গাজীপুর সিটির মতো নির্বাচন হলে মোটামুটি চলে যাবে। বিদ্রোহী জিতলেও অসুবিধা নেই। আসন দলেই থাকে। প্রশ্ন হলো আমরা এভাবে চলতেই থাকবো কিনা?  

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচন কালীন সরকার নিয়ে বাংলাদেশের আজন্ম বিড়ম্বনা এখন আর কারো অজানা নয়। সুষ্টু নির্বাচন দিতে না চাওয়াটা রাজনৈতিক দলগুলোর একেবারে মজ্জাগত চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সমাজ রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে এটার ব্যাখ্যা দিয়ে আসছেন। ব্যাখ্যাটি হলো - বাংলাদেশের মত প্রতিশোধ   আক্রোশ প্রবণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা হারানো বিরোধী দলে যাওয়াটা অত্যন্ত বিপদজনক। ব্যাখ্যার গ্রহণযোগ্যতা সর্বমহলে স্বীকৃত। আমি খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দেশের রাজনীতি হতে এই ক্ষমতা হারানোর ভয় দূর করা না গেলে নির্বাচন বা নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা অদলবদলের ব্যাপারে বাকি সব তাত্ত্বিক, আইনি সাংবিধানিক আলাপ-আলোচনা শূন্যে পর্যবসিত হবে।


Photo Credit: Indranil Mukherjee/AFP/Getty Images


বর্তমান সরকারি দল ১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্টে স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, নভেম্বরের জেল হত্যা, খালেদ মোশাররফ হত্যা, ১৯৭৫ এর পর শত শত মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, ১৯৮৪ সালের ২৪ মার্চ চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানের গণহত্যা, ২০০৫ সালে ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হত্যা, ২০০১- ২০০৬ সালে আহসান উল্লাহ মাস্টার, শাহ এম এস কিবরিয়া হত্যা, খুলনার মঞ্জুরুল ইমাম হত্যা, কাজী আরেফ হত্যা, রমনার বটমূলের বোমা হামলা, সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলা, বাংলা ভাইয়ের উত্থান, ২০০১ এর পরে দেশব্যাপী রাজনৈতিক কর্মী সনাতন ধর্মী সম্পদায় নিধনযজ্ঞ সহ অন্যান্য রাজনৈতিক নিপীড়ণের কথা তুলতে পারেন। ক্ষমতা পরিবর্তন হলে দেশে রক্ত গঙ্গা বয়ে যাওয়ার আশংকাও তাঁরা করেন। মোটাদাগে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও এটি উড়িয়ে দেন না।

একই ভাবে বর্তমান বিরোধী দলের হাতেও রাজনৈতিক রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণের লম্বা তালিকা আছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এটিকেও উড়িয়ে দেবেন না। বর্তমানের সরকারি দলের হিসেবে বিরোধী দলের আরেকটি একটি অতিরিক্ত বিপদজনক তালিকা হলো - ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধ মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার। এটিকে "রাজনৈতিক নিপীড়ন" গণ্য করার  প্রবণতা বিরোধী দলের মধ্যে আছে। বর্তমান প্রধান বিরোধী দল ক্ষমতায় আসার মানে জামায়াত ইসলামীর ক্ষমতায় আসা - এমন ধারণাও জনমনে বদ্ধমূল। ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার কোন চেষ্টা বিরোধী দলের আছে বলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় না।

প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের ব্যাপারে দেশীয় বা আন্তর্জাতিক মহল যারাই উদ্যোগ নেন, তাঁদের সর্ব প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত এটাই। আমাদের সংকট আসলে সাংবিধানিক নয়। সংকটটি ঐতিহাসিক, ব্যক্তিগত, পারিবারিক সামাজিক শত্রুতার। আস্থাহীনতা, ভীতি শত্রুতা নিরসন প্রতিশোধ না নেয়ার ব্যাপারে একটি গোপন সমঝোতা হলেও যদি করা যায়, তাহলে পরের ধাপের রাজনৈতিক, আইনি সাংবিধানিক সমঝোতার আলাপ প্রকাশ্যে করা যেতে পারে। সমস্যার গোড়াটাতে হাত না দিয়ে বা এটিকে পাশ কাটিয়ে আইনের শাসন, গনতন্ত্র, জনগণের ভোটাধিকার ইত্যাদি নিয়ে আমরা যারা নানা ধরণের প্রেসক্রিপশন দিই সেগুলো অনেকটাই তাত্ত্বিক। রাজনৈতিক দলগুলোর সেগুলো কাছে "প্রাকটিক্যাল গ্রাউন্ডে" পাত্তা পায় না তাঁরা বরং এগুলোকে "ষড়যন্ত্রের অংশ" হিসেবেই দেখতে অভ্যস্থ। তাছাড়া এগুলোর মাধ্যমে দেশের সাংবিধানিক রূপকাঠামোর দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকার সক্ষমতাও নিশ্চিত হয় না। একটা উদাহরণ দিই।

বর্তমান সরকারি দলের নেতৃত্বে ১৯৯৪-৯৬ পর্যন্ত দুই বছরের হরতাল, ধর্মঘট অবরোধের মাধ্যমে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করা হচ্ছিলো তখন ওই সরকারের সাংবিধানিক রূপরেখা নিয়ে আমাদের নাগরিক সমাজের বা জনগণের বা এমন কি আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর আনুষ্ঠানিক অংশ গ্রহণের কোন সুযোগ ছিলো না। বিরোধী দলগুলো রাস্তায় আন্দোলন করছিলো। গণমাধ্যম সুশীল সমাজ তাঁদের আন্দোলনকে যৌক্তিক বিবেচনা করে সমর্থন করছিলো। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা বলতে যেটা ছিল সেটা মোটা দাগে রকম - নির্বাচনের সময় সুপ্রিম কোর্টের সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি নির্দলীয় সরকার হবে। তারা তিন মাসের ভেতর নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেবে।



Photo Credit: Reuters/Mohammad Ponir Hossain (March 2023)

নিতান্ত চাপে পড়ে তৎকালীন সরকারি দল যে সরকারটি দিয়ে গেলেন সেটির মূল লক্ষ্য ছিল  তাঁদের দলীয় রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে কিভাবে ক্ষমতায়িত করা যায়। রাস্তায় আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকেও ১৩-তম সংশোধনীর খুঁটিনাটি নিয়ে তেমন মাথা ব্যাথা দেখানো হয় নি। তাঁদের তাৎক্ষণিক দাবি বিএনপি সরকারের বিদায়েই তাঁরা সন্তুষ্ঠ ছিলেন। অথচ একজন দলীয় রাষ্ট্রপতির হঠাৎ ক্ষমতাবান হয়ে উঠার বিপদ আমরা প্রথম বারেই টের পেয়েছিলাম। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস জেনারেল নাসিমকে সরিয়ে বিএনপি সমর্থক সেনা প্রধান মাহবুবুর রহমানকে বসাতে চাইলেন। এর মাধ্যমে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেলে দিয়ে সামরিক শাসন জারি করার একটা পরিস্থিতি তৈরী করে বসলেন।

যেনতেন ভাবে ক্ষমতায় থাকার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলো যে কোন সাংবিধানিক ব্যবস্থাকেই (সেটি যত ভালোই হোক না কেন) নষ্ট করে দিতে পারে। ব্যাপারটি আমরা আবারো দেখেছি ১৩-তম সংশোধনীর পরে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে নজিরবিহীন অকল্পনীয় দলীয়করণের মধ্যে। ২০০৪ সালে এসে তৎকালীন সরকারি দল তাঁদের দলীয় প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বানানোর জন্য একেবারে সংবিধানে হাত দিয়ে দিলেন। সেটি করতে না পেরে ২০০৬ সালে এসে দলীয় রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে পুরো তত্ত্বাবধায়ক সরকারটাই ছিনতাই করলেন। এর মাধ্যমে দেশে আরেকটি সরাসরি সেনা হস্তক্ষেপ সংবিধান বহির্ভুত সরকার আসলো। ২০১১ সালে এসে তৎকালীন সরকারি দল সংস্কারের পথে না গিয়ে জনগণের মতামতকে এক রকম অবজ্ঞা করে একক সিদ্ধান্তে পুরো ব্যবস্থাটাই বাতিল করে দিলেন

আদালতের যে রায়ের দোহাই দিয়ে ব্যবস্থাটি বাতিল হলো, সে রায়টি নিয়ে আমরা অনেকেই বিচারকের অত্যন্ত কড়া সমালোচনা করি। অথচ রায়টিতেই ব্যবস্থাটির ত্রুটিগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছিল। আরো অন্তত দুই মেয়াদে ব্যবস্থাটি রেখে দেয়ার কথা বলে এটির ত্রুটি সারানোর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে কমপক্ষে পনের বছর সময় দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল মনে করেছেন তারা ক্ষমতায় এসেই গেছেন এবং ভবিষ্যত নির্বাচনগুলো তাঁরা নিজেদের পছন্দ মতো উপায়ে করে ফেলতে পারবেন (সেটি তাঁরা পেরেছেনও) ফলে তাঁরা আর সংস্কারের ধার ধারেন নি। সরাসরি বাতিল করে দিয়েছেন।

লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, ২০১১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোর  ভেতরও নির্বাচন নিয়ে দেশের আজন্ম সংকটি নিয়ে কোন স্থায়ী সৎচিন্তা প্রসূত প্রস্তাব আছে বলে আমার মনে হয় নি। ১৯৯৬ ২০০৬ সালে তাঁদের সংবিধান বিরোধী কার্যকলাপের ব্যাপারে অনুশোনা বা ভুল স্বীকার করার কোন ইঙ্গিত আমরা এখন পর্যন্ত পাই নি। ২০১৪ নির্বাচনের আগে তাঁরা এক মেয়াদি একটা  প্রস্তাব দিলেন। বললেন ১৯৯১, ১৯৯৬ ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের লোকজন নিয়ে ২০১৪ সালের সরকারটি গঠিত হোক। বোধগম্যভাবেই আমার মতো অনেকের মনে হয়েছে এটি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কোন স্থায়ী বা দীর্ঘ মেয়াদি চিন্তা নয়। এটি শুধু মাত্র ওই নির্বাচনটি পার হওয়ার চেষ্টা। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের নির্বাচন বা আগামী নির্বাচনের প্রেক্ষাপটেও আমরা কোন স্থায়ী চিন্তা বা সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতির ইঙ্গিত পাচ্ছি না। প্রস্তাব যেগুলো এসেছে সেগুলো কেবল সংবিধানের নানা বিধি-বিধানের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিভাবে পদত্যাগ করে অন্য কাউকে সরকারের দায়িত্বে আনতে পারেন সে সংক্রান্ত। প্রস্তাবগুলোও এক মেয়াদি। ধরণের একটি নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় আসবেন তাঁরা পরের বার ব্যবস্থাটি মানবেন সে রকম কোন ইঙ্গিত বা সম্ভাবনার কথা আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলো সচেতনভাবেই এড়িয়ে যান। ব্যাপারে আমরাও তাঁদের কিছু জিজ্ঞেস করছি না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট ঐতিহাসিক।    

মূলত প্রেক্ষিতেই বলছি, সমঝোতা বা সংলাপের উদ্যোগ দেশি বা বিদেশী মহল থেকে যারাই নেবেন তাঁদের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে পারস্পরিক প্রতিশোধ না নেয়ার একটা গোপন সমঝোতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। সেটি নিশ্চিত করা গেলেই কেবল পরের ধাপে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি, তাঁদের নিজ নিজ দলীয় বুদ্ধিজীবী আইনজীবী, দল নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী নাগরিক সমাজের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কনভেনশন আহবান করা যেতে পারে যেখানে আমরা নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে অতীতের ভুল ত্রুটির বাছবিচার করে একটি স্থায়ী সাংবিধানিক কাঠামো তৈরী করতে পারবো। বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস বলছে, দ্বন্ধপ্রবণ রাজনৈতিক দলগুলোর খাম খেয়ালি ক্ষমতা লিপ্সার  হাতে দেশের শাসন ক্ষমতা সংবিধানকে একচ্ছত্রভাবে ছেড়ে দিয়ে জনগণের খুব বেশি লাভ হয় নি। সিভিল সোসাইটির যারা দীর্ঘ মেয়াদি সংস্কার বাদ দিয়ে কেবলমাত্র প্রতি পাঁচ বছর পর পর সরকারি দল বিরোধী দলের চেয়ার অদল-বদল এবং এর মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক অপশাসনের চক্র (Cycle of Competitive Mis-governance) চালিয়ে নেয়াকে গণতন্ত্র সুশাসনের মডেল মনে করেন তাঁরাও কতটা দেশের জন্য ভাবেন আর কতটা বিশেষ বিশেষ পরাশক্তির জন্য কাজ করেন সেটা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।

অতিরিক্ত বিচারপতিদের স্থায়ীকরণ প্রসঙ্গে মহামান্য আপিল বিভাগের সাম্প্রতিক রায়: একটি প্রাথমিক মূল্যায়ন ল'ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ সাক্ষাৎকার ...