বাংলাদেশের নির্বাচন সংকট ও সমাধান চিন্তা
ড এম জসিম আলী চৌধুরী
প্রভাষক, আইন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব হল, যুক্তরাজ্য
ই-মেইল: J.Chowdhury@hull.ac.uk
সন্দেহ নেই আমরা আরেকটি একতরফা নির্বাচনের দিকে আগাচ্ছি। ২০১৪ হতে প্রতিটি এক তরফা নির্বাচনের কৌশল ভিন্ন ভিন্ন।
২০১৪ সালে অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতার নির্বাচন করে সরকারি দল বিরোধীদলের ভয়াবহ প্রতিরোধের ক্ষেত্র কমিয়ে দিয়েছিলো। এর ফলে সরকারি পুলিশ ও প্রশাসনের চাপ অর্ধেক কমে যায়। এটি ছিল কার্যত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তৎকালীন সরকারি দলের সারা দেশে এক তরফা নির্বাচন করতে না পারার "ভুল" থেকে নেয়া "শিক্ষা"।
২০১৮ সালে ছিল ২০১৪ সালে বিএনপি "অংশ না নিয়ে ভুল করেছে" এমন জিগিরের উপর চালিয়ে নেয়া। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরটা দেশে ছিলাম। সারা মাসে বিরোধী দলকে ফেসবুক ও পত্রিকায় ছাড়া মাঠের কোথাও দেখি নি। পুলিশি চাপ ছিলো। আগের পাঁচ বছরে বিরোধী দলের ব্যাপক শক্তিক্ষয়ও ছিল লক্ষণীয়। মনে হচ্ছিলো সরকারি দল জিতবে। তারপরও তারা রিস্ক নেন নি। আগের রাতে ব্যালট ভরে যায়। ভোটের দিন সকাল ১১টা-র ভেতর সব কেন্দ্র দখল হয়ে যায়।
২০২৪ সালে এরকম হবে না। বিরধীদের ২০১৪ মত অবস্থা নেই। সুতরাং আইন শৃঙ্খলা নিয়ে অত চাপ নেয়ারও কিছু নেই। প্রায় সব আসনে দলের নির্ধারিত প্রার্থীর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাখা হবে। সমঝোতায় বিরোধী দলকেও কিছু আসন ছাড়া হবে। মোটামুটি প্রতিদ্বন্ধিতা থাকবে। হানাহানি যেন অতিরিক্ত না হয় (যেমনটি ইউ পি নির্বাচনগুলোতে হয়েছিল) সেদিকে খেয়াল রাখা হবে । মডেলটি ইতোমধ্যে বেশ কিছু সিটি কর্পোরেশনে পরীক্ষা করে ফেলা হয়েছে। এটি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষত গাজীপুর সিটির মতো নির্বাচন হলে মোটামুটি চলে যাবে। বিদ্রোহী জিতলেও অসুবিধা নেই। আসন দলেই থাকে। প্রশ্ন হলো আমরা এভাবে চলতেই থাকবো কিনা?
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচন কালীন সরকার নিয়ে বাংলাদেশের আজন্ম বিড়ম্বনা এখন আর কারো অজানা নয়। সুষ্টু নির্বাচন দিতে না চাওয়াটা রাজনৈতিক দলগুলোর একেবারে মজ্জাগত চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে এটার ব্যাখ্যা দিয়ে আসছেন। ব্যাখ্যাটি হলো - বাংলাদেশের মত প্রতিশোধ ও আক্রোশ প্রবণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা হারানো ও বিরোধী দলে যাওয়াটা অত্যন্ত বিপদজনক। এ ব্যাখ্যার গ্রহণযোগ্যতা সর্বমহলে স্বীকৃত। আমি খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দেশের রাজনীতি হতে এই ক্ষমতা হারানোর ভয় দূর করা না গেলে নির্বাচন বা নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা অদলবদলের ব্যাপারে বাকি সব তাত্ত্বিক, আইনি ও সাংবিধানিক আলাপ-আলোচনা শূন্যে পর্যবসিত হবে।
একই ভাবে বর্তমান বিরোধী দলের হাতেও রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণের লম্বা তালিকা আছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এটিকেও উড়িয়ে দেবেন না। বর্তমানের সরকারি দলের হিসেবে বিরোধী দলের আরেকটি একটি অতিরিক্ত বিপদজনক তালিকা হলো - ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার। এটিকে "রাজনৈতিক নিপীড়ন" গণ্য করার প্রবণতা বিরোধী দলের মধ্যে আছে। বর্তমান প্রধান বিরোধী দল ক্ষমতায় আসার মানে জামায়াত ইসলামীর ক্ষমতায় আসা - এমন ধারণাও জনমনে বদ্ধমূল। এ ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার কোন চেষ্টা বিরোধী দলের আছে বলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় না।
এ প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের ব্যাপারে দেশীয় বা আন্তর্জাতিক মহল যারাই উদ্যোগ নেন, তাঁদের সর্ব প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত এটাই। আমাদের সংকট আসলে সাংবিধানিক নয়। সংকটটি ঐতিহাসিক, ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক শত্রুতার। আস্থাহীনতা, ভীতি ও শত্রুতা নিরসন ও প্রতিশোধ না নেয়ার ব্যাপারে একটি গোপন সমঝোতা হলেও যদি করা যায়, তাহলে পরের ধাপের রাজনৈতিক, আইনি ও সাংবিধানিক সমঝোতার আলাপ প্রকাশ্যে করা যেতে পারে। সমস্যার গোড়াটাতে হাত না দিয়ে বা এটিকে পাশ কাটিয়ে আইনের শাসন, গনতন্ত্র, জনগণের ভোটাধিকার ইত্যাদি নিয়ে আমরা যারা নানা ধরণের প্রেসক্রিপশন দিই সেগুলো অনেকটাই তাত্ত্বিক। রাজনৈতিক দলগুলোর সেগুলো কাছে "প্রাকটিক্যাল গ্রাউন্ডে" পাত্তা পায় না । তাঁরা বরং এগুলোকে "ষড়যন্ত্রের অংশ" হিসেবেই দেখতে অভ্যস্থ। তাছাড়া এগুলোর মাধ্যমে দেশের সাংবিধানিক রূপকাঠামোর দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকার সক্ষমতাও নিশ্চিত হয় না। একটা উদাহরণ দিই।
বর্তমান সরকারি দলের নেতৃত্বে ১৯৯৪-৯৬ পর্যন্ত দুই বছরের হরতাল, ধর্মঘট ও অবরোধের মাধ্যমে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করা হচ্ছিলো তখন ওই সরকারের সাংবিধানিক রূপরেখা নিয়ে আমাদের নাগরিক সমাজের বা জনগণের বা এমন কি আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর আনুষ্ঠানিক অংশ গ্রহণের কোন সুযোগ ছিলো না। বিরোধী দলগুলো রাস্তায় আন্দোলন করছিলো। গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ তাঁদের আন্দোলনকে যৌক্তিক বিবেচনা করে সমর্থন করছিলো। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা বলতে যেটা ছিল সেটা মোটা দাগে এ রকম - নির্বাচনের সময় সুপ্রিম কোর্টের সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি নির্দলীয় সরকার হবে। তারা তিন মাসের ভেতর নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেবে।
নিতান্ত চাপে পড়ে তৎকালীন সরকারি দল যে সরকারটি দিয়ে গেলেন সেটির মূল লক্ষ্য ছিল তাঁদের দলীয় রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে কিভাবে ক্ষমতায়িত করা যায়। রাস্তায় আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকেও ১৩-তম সংশোধনীর খুঁটিনাটি নিয়ে তেমন মাথা ব্যাথা দেখানো হয় নি। তাঁদের তাৎক্ষণিক দাবি বিএনপি সরকারের বিদায়েই তাঁরা সন্তুষ্ঠ ছিলেন। অথচ একজন দলীয় রাষ্ট্রপতির হঠাৎ ক্ষমতাবান হয়ে উঠার বিপদ আমরা প্রথম বারেই টের পেয়েছিলাম। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস জেনারেল নাসিমকে সরিয়ে বিএনপি সমর্থক সেনা প্রধান মাহবুবুর রহমানকে বসাতে চাইলেন। এর মাধ্যমে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেলে দিয়ে সামরিক শাসন জারি করার একটা পরিস্থিতি তৈরী করে বসলেন।
যেনতেন ভাবে ক্ষমতায় থাকার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলো যে কোন সাংবিধানিক ব্যবস্থাকেই (সেটি যত ভালোই হোক না কেন) নষ্ট করে দিতে পারে। ব্যাপারটি আমরা আবারো দেখেছি ১৩-তম সংশোধনীর পরে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে নজিরবিহীন ও অকল্পনীয় দলীয়করণের মধ্যে। ২০০৪ সালে এসে তৎকালীন সরকারি দল তাঁদের দলীয় প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বানানোর জন্য একেবারে সংবিধানে হাত দিয়ে দিলেন। সেটি করতে না পেরে ২০০৬ সালে এসে দলীয় রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে পুরো তত্ত্বাবধায়ক সরকারটাই ছিনতাই করলেন। এর মাধ্যমে দেশে আরেকটি সরাসরি সেনা হস্তক্ষেপ ও সংবিধান বহির্ভুত সরকার আসলো। ২০১১ সালে এসে তৎকালীন সরকারি দল সংস্কারের পথে না গিয়ে ও জনগণের মতামতকে এক রকম অবজ্ঞা করে একক সিদ্ধান্তে পুরো ব্যবস্থাটাই বাতিল করে দিলেন ।
আদালতের যে রায়ের দোহাই দিয়ে ব্যবস্থাটি বাতিল হলো, সে রায়টি নিয়ে আমরা অনেকেই বিচারকের অত্যন্ত কড়া সমালোচনা করি। অথচ এ রায়টিতেই ব্যবস্থাটির ত্রুটিগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছিল। আরো অন্তত দুই মেয়াদে ব্যবস্থাটি রেখে দেয়ার কথা বলে এটির ত্রুটি সারানোর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে কমপক্ষে পনের বছর সময় দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল মনে করেছেন তারা ক্ষমতায় এসেই গেছেন এবং ভবিষ্যত নির্বাচনগুলো তাঁরা নিজেদের পছন্দ মতো উপায়ে করে ফেলতে পারবেন (সেটি তাঁরা পেরেছেনও)। ফলে তাঁরা আর সংস্কারের ধার ধারেন নি। সরাসরি বাতিল করে দিয়েছেন।
লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, ২০১১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরও নির্বাচন নিয়ে দেশের আজন্ম সংকটি নিয়ে কোন স্থায়ী ও সৎচিন্তা প্রসূত প্রস্তাব আছে বলে আমার মনে হয় নি। ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালে তাঁদের সংবিধান বিরোধী কার্যকলাপের ব্যাপারে অনুশোনা বা ভুল স্বীকার করার কোন ইঙ্গিত আমরা এখন পর্যন্ত পাই নি। ২০১৪ নির্বাচনের আগে তাঁরা এক মেয়াদি একটা প্রস্তাব দিলেন। বললেন ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের লোকজন নিয়ে ২০১৪ সালের সরকারটি গঠিত হোক। বোধগম্যভাবেই আমার মতো অনেকের মনে হয়েছে এটি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কোন স্থায়ী বা দীর্ঘ মেয়াদি চিন্তা নয়। এটি শুধু মাত্র ওই নির্বাচনটি পার হওয়ার চেষ্টা। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের নির্বাচন বা আগামী নির্বাচনের প্রেক্ষাপটেও আমরা কোন স্থায়ী চিন্তা বা সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতির ইঙ্গিত পাচ্ছি না। প্রস্তাব যেগুলো এসেছে সেগুলো কেবল সংবিধানের নানা বিধি-বিধানের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিভাবে পদত্যাগ করে অন্য কাউকে সরকারের দায়িত্বে আনতে পারেন সে সংক্রান্ত। এ প্রস্তাবগুলোও এক মেয়াদি। এ ধরণের একটি নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় আসবেন তাঁরা পরের বার এ ব্যবস্থাটি মানবেন সে রকম কোন ইঙ্গিত বা সম্ভাবনার কথা আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলো সচেতনভাবেই এড়িয়ে যান। এ ব্যাপারে আমরাও তাঁদের কিছু জিজ্ঞেস করছি না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট ঐতিহাসিক।
মূলত এ প্রেক্ষিতেই বলছি, সমঝোতা বা সংলাপের উদ্যোগ দেশি বা বিদেশী মহল থেকে যারাই নেবেন তাঁদের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে পারস্পরিক প্রতিশোধ না নেয়ার একটা গোপন সমঝোতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। সেটি নিশ্চিত করা গেলেই কেবল পরের ধাপে, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি, তাঁদের নিজ নিজ দলীয় বুদ্ধিজীবী ও আইনজীবী, দল নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কনভেনশন আহবান করা যেতে পারে যেখানে আমরা নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে অতীতের ভুল ত্রুটির বাছবিচার করে একটি স্থায়ী সাংবিধানিক কাঠামো তৈরী করতে পারবো। বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস বলছে, দ্বন্ধপ্রবণ রাজনৈতিক দলগুলোর খাম খেয়ালি ও ক্ষমতা লিপ্সার
হাতে দেশের শাসন ক্ষমতা ও সংবিধানকে একচ্ছত্রভাবে ছেড়ে দিয়ে জনগণের খুব বেশি লাভ হয় নি। সিভিল সোসাইটির যারা দীর্ঘ মেয়াদি সংস্কার বাদ দিয়ে কেবলমাত্র প্রতি পাঁচ বছর পর পর সরকারি দল ও বিরোধী দলের চেয়ার অদল-বদল এবং এর মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক অপশাসনের চক্র (Cycle of Competitive
Mis-governance) চালিয়ে নেয়াকে গণতন্ত্র ও সুশাসনের মডেল মনে করেন তাঁরাও কতটা দেশের জন্য ভাবেন আর কতটা বিশেষ বিশেষ পরাশক্তির জন্য কাজ করেন সেটা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।