Tuesday, March 26, 2019

দন্ডিত ব্যক্তির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রশ্নে


এম জসিম আলী চৌধুরী 


অনলাইন লিংকঃ দৈনিক সমকাল, মুক্তমঞ্চ পাতা, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৮


বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনেক দিন ধরেই আমাদের উচ্চ আদালতের জন্য এক গোলকধাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৬৬(২)(ঘ)-এর মূলকথা হচ্ছে, নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে দুই বছর বা তার বেশি মেয়াদে কেউ দণ্ডিত হলেই তিনি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অধিকার হারাবেন। ইতিমধ্যে  কেউ নির্বাচিত হয়ে গেলে তিনি পদ  হারাবেন। সংবিধানের এই আপাত সহজ বিধানটি অবশ্য আমাদের জন্য আর সহজ নেই। থাকার কথাও নয়। এটি আমার-আপনার মতো আমজনতার আইন না। সংসদ নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর হোমরাচোমরা নেতা-নেত্রীরা অংশ নেন। অতএব, আইনের সঙ্গে পলিটিক্সও পেঁচিয়ে গেছে। ৬৬(২)(ঘ)-এর পেঁচগি মূলত দুটি।


এক. ফৌজদারি বিচারিক আদালতে শাস্তি হয়তো আপনি পেলেন। আপনি আপিল করতে পারেন অথবা একেবারে শেষে গিয়ে রিভিউ দরখাস্ত দাখিল করতে পারেন। বিভিন্ন সময়ে রাজনীতিকরা দাবি করেন, আপিল বা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিচারিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত এবং সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আপনি দোষী বা দণ্ডিত বলতে পারবেন না। দুই. ধরা যাক চূড়ান্ত দোষী সাব্যস্ত বা দণ্ডিত হয়েই গেলেন। তখন আবার আপনি বলতে পারেন, এই দোষ মামুলি দোষ; নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ না। প্রথম পেঁচগি- সাজার চূড়ান্ততা নিয়ে কয়েকটি ঘটনা স্মরণ করা যাক। 


ঘটনা এক। আপিল নিষ্পত্তির আগ পর্যন্ত নিষ্পাপ ধরে নেওয়ার দাবিটি আসে সিরাজুল হক বনাম নূর আহমেদ (১৯ ডিএলআর ৭৬৬) মামলায়। ভদ্রলোক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ইলেকটোরাল কলেজের মেম্বার হন। মেম্বার হিসেবে ভোট দিয়ে আরেকজনকে নির্বাচিতও করে দেন। ওই  সময়ে তার একটি ফৌজদারি দণ্ডের আপিল ঝুলে ছিল। উচ্চ আদালত বলেন, আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি নির্দোষ (প্যারা ৫, পৃষ্ঠা ৭৬৮)। পরে দেখা যায়, আপিলে তার দণ্ড বহাল থাকে। প্রশ্ন আসে, তার দেওয়া ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তি কি এখন পদ হারাবেন? দণ্ডিত ব্যক্তির ভোটটি ছিল একেবারে বিজয় নির্ধারক। আদালত বলেন, সাজার কার্যকারিতা আপিলের আগে থেকে পেছনে গিয়ে কার্যকর হবে না। সুতরাং যিনি নির্বাচিত হয়েই গেছেন, তার কোনো সমস্যা নেই। এখানে যে বিষয়টি যুক্তিতে আসে না সেটি হলো, সাধারণ নিয়মে দণ্ডিত ব্যক্তি আপিল করার আগে জেলে থেকে আপিল করার কথা। আপিলের আগে যে সময়টুকু জেল খেটেছেন, সেটি আপিলের পর চূড়ান্ত হওয়া জেল থেকে বাদ যাওয়ার কথা। এগুলো যদি পেছন থেকে কার্যকর হয়, তাহলে নির্বাচিত চেয়ারম্যানের গদি ঠিক থাকে কীভাবে? আদালত সাধারণত সেটেল্ড হয়ে যাওয়া প্রশাসনিক জিনিস আর ঘাঁটাতে চান না।

ঘটনা দুই। ১৯৯৬ সাল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। জনতা টাওয়ার মামলার দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল হাইকোর্ট বিভাগে অপেক্ষমাণ। এরশাদের দোষ এবং সাজা কোনোটাই স্থগিত হয়নি। শুধু আপিল বিবেচনাধীন। রিটার্নিং অফিসার প্রার্থিতা বহাল রাখেন। মামলা হলো- মঈদুল ইসলাম বনাম ইলেকশন কমিশন (৪৮ ডিএলআর (এডি) ২০৮)। হাইকোর্ট বিভাগ বলেন, আপিল নিষ্পত্তির আগে কেউ দণ্ডিত নন (প্যারা ৫, পৃষ্ঠা ২০৯)। আপিল বিভাগ বলেন, তফসিল  ঘোষণার পর এগুলো নির্বাচনী বিষয়। নির্বাচনী বিষয় নিয়ে রিট চলে না (প্যারা ৭, পৃষ্ঠা ২০৯)। শাস্তির চূড়ান্ততা নিয়ে আপিল বিভাগের কোনো মন্তব্য নেই বলে মনে হতে পারে। তবে বিচারপতি মোস্তফা কামাল একটু ইশারা দিয়ে বলেন, আপিল নিষ্পত্তি না হওয়ায় হয়তো রিটার্নিং অফিসার শাস্তিকে চূড়ান্ত মনে করেননি। তিনি সে রকম কিছু মনে করলে সেটার বিরুদ্ধে রিট চলে না।

ঘটনা তিন। ২০০০ সালের দিকে এসে আপিলে এরশাদ হেরে গেলেন। এরশাদ তখন বিএনপি জোটে। সরকারে আওয়ামী লীগ। আদিষ্ট হয়ে সংসদ সচিব আব্দুল মোক্তাদির চৌধুরী গেজেট প্রজ্ঞাপন করে দিলেন- এরশাদ আর এমপি নেই। এবার এরশাদের মামলা। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বনাম আব্দুল মোক্তাদির চৌধুরী (২০০১ ডিএলআর ৫৬৯)। এরশাদ বলছেন, আপিল নিষ্পত্তি হয়েছে তো কী হয়েছে? আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন তো আছেই (প্যারা ৪, পৃষ্ঠা ৫৭১)।

বিচারপতি জয়নুল আবেদীন (পরে যিনি ২১ আগস্ট  গ্রেনেড হামলার তদন্ত করে বিদেশি শক্তির সংশ্নিষ্টতা পেয়েছিলেন) প্রশ্ন করেন- যদি চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আগে কাউকে বাদ দিয়ে দিই, তাহলে সেখানে উপনির্বাচন হতে পারে। উপনির্বাচনে অন্য কেউ জয়ী হতে পারেন। পরে মূল ব্যক্তির সাজা বাতিল হয়ে যেতে পারে। তখন উপনির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তির কী হবে? লক্ষ্য করুন, এরশাদের শাস্তি কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপিল বিভাগে বহাল হয়েছে। তিনি এখন শুধু রিভিউ করেছেন। যদি একেবারে মাথার ওপর ন্যায়বিচারের আসমান ভেঙে না পড়ে, তাহলে রিভিউতে শাস্তি আমূল বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা কতদূর, সেটা আইনজীবীমাত্রই অনুধাবন করেন। তথাপি বিচারপতি জয়নুল আবেদীন প্রশ্নটি তোলেন। জবাব দিতে গিয়ে ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর কিছুটা গুলিয়ে ফেলেন। মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বনাম নির্বাচন কমিশন (৫০ ডিএলআর ৪১৭) মামলার বরাত দিয়ে তানিয়া আমীর বলেন, যিনি উপনির্বাচনে অংশ নেবেন, তিনি এটা জেনেই অংশ নেবেন যে, আগের ব্যক্তি চূড়ান্ত খালাস পেলে তার পদ টিকবে না (প্যারা ১৮, পৃষ্ঠা ৫৭৪)। এ যুক্তিটি বিচারপতি জয়নুল আবেদীন গ্রহণ করেননি (প্যারা ২০, পৃষ্ঠা ৫৭৪)। বিচারপতি জয়নুল আবেদীন সিরাজুল হক বনাম নূর আহমদ (ওপরে বর্ণিত ঘটনা এক) মামলার রেফারেন্স দিয়ে বলেন, এমনকি রিভিউ নিষ্পত্তি হওয়ার আগেও এরশাদকে দোষী বলা যাবে না (প্যারা ২১ ও ২২, পৃষ্ঠা ৫৭৫)। 

একই বেঞ্চের অপর বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক (পরে প্রধান বিচারপতি) বলেন, সিরাজুল হক মামলাটি আইনের সঠিক প্রতিফলন নয়। তার মতে, ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদে দণ্ডের কথা বলা আছে।  আমরা নিজেরা এক কদম বাড়িয়ে এটাকে চূড়ান্ত দণ্ড বলতে পারি না (প্যারা ৪৭, পৃষ্ঠা ৫৮৪-৮৫)। তিনি আরও বলেন, এভাবে আপিলের দোহাই দিয়ে ইচ্ছামতো আইনের চেতনা (দুর্নীতিবাজমুক্ত আইনসভা) ভূলুণ্ঠিত হওয়া মেনে নেওয়া  যায় না (প্যারা ৬২, ৬৩, পৃষ্ঠা ৫৯০-৯১)। মামলাটি অন্য এক ইস্যুতে নিষ্পত্তি হয়। আপিল ও দণ্ডের চূড়ান্ততা নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগের দুই বিচারকের দুই রকম  অবস্থান থেকেই যায়। আপিল বিভাগ পর্যন্ত ব্যাপারটা আর এখনও গড়ায়নি। 

ঘটনা চার। ২০০৭ সাল। সেনা সরকার আসার পর রাজনীতিবিদদের বিচার শুরু হলো পুরোদমে। তড়িঘড়ি করে অনেকের শাস্তি হলো। ড মহীউদ্দীন খান আলমগীরেরও হলো; ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন আইনে। ঠিক সামরিক আদালত নয়, তবে সেনা সরকারের ইমার্জেন্সি পাওয়ার রুলের আওতায় দ্রুত বিচার করে দেওয়া হলো। মহীউদ্দীন খান আলমগীর আপিল নিয়ে হাইকোর্টে  গেলেন। শাস্তি স্থগিত হলো। জামিনও হলো। তারপরও নির্বাচনে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নমিনেশন পেপার বাতিল করে দেওয়া হলো। তিনি হাইকোর্টে গেলেন। হাইকোর্ট বললেন, নির্বাচনী বিষয়ে রিট চলে না। রিটার্নিং অফিসার যা বুঝেছেন করেছেন। মহীউদ্দীন খান আলমগীর আপিল বিভাগে গেলেন। মূল শুনানির আগে চেম্বার জজের কাছে গেলেন। তিনি হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত স্থগিত করলেন। রিটার্নিং অফিসারকে নমিনেশন পেপার নিতে বললেন। মহীউদ্দীন খান আলমগীর নির্বাচনে জিতেও গেলেন। ওদিকে ২০১০ সালে এসে মূল শুনানিতে আপিল বিভাগ হাইকোর্টেরটাই বহাল রাখলেন। বলা হলো, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী বিরোধগুলো নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার। এগুলো নিয়ে রিট চলে না (ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বনাম বাংলাদেশ, ৬২ ডিএলআর (এডি) ৪২৫)।

এবার এরশাদের মতো ঘটনা ঘটল। মহীউদ্দীন আলমগীরের পদ শূন্য ঘোষিত হলো। তিনি আবার রিট করলেন। শূন্য ঘোষণা স্থগিত হলো। রিট নিষ্পত্তি হতে হতেই মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মূল শাস্তি হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে রহিত হলো। দণ্ড স্থগিত ও আরও নানা রকম স্থগিতাদেশের জোরে মহীউদ্দীন খান আলমগীর মাঝের সময়টা চালিয়ে গেলেন। এদিকে সাজার চূড়ান্ততা নিয়ে মূল প্রশ্নের সুরাহা আর হলো না।

ঘটনা পাঁচ। খালেদা জিয়ার ঘটনার পর ব্যাপারটা আবার এসেছে। সম্প্রতি হাইকোর্টের বিভিন্ন বেঞ্চ বিভিন্ন রকম রায় দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, আপিল চলাকালীন সাজা স্থগিত না থাকলে বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্তের পরেই নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। কেউ বলছেন, আপিলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পরেই অযোগ্যতা তৈরি হবে।

খালেদা জিয়ার সাজা হাইকোর্ট বিভাগে রদ হওয়ার বদলে উল্টো বেড়ে গেছে। বিচারিক আদালতে এ মামলার গতি-প্রকৃতি দেখলে অবাক হতে হয়। মামলার শুনানির তারিখ কতবার যে কত অজুহাতে তার আইনজীবীরা পিছিয়েছেন, সে হিসাব করতে গেলে মাথা ঘুরবে। মামলার বিচারকের ওপর কতবার অনাস্থা জানিয়ে হাইকোর্টে গিয়ে কতবার ঝুলানো হয়েছে, তার ইয়ত্তা রাখা কঠিন। 

ওপরে আলোচিত পাঁচ-পাঁচটি ঘটনার কোনোটিতেই সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদের মূল চেতনা কি প্রতিফলিত হয়েছে? দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের জনগণের প্রতিনিধিত্ব থেকে সরিয়ে রাখার যে শপথ আমরা ১৯৭২ সালের সংবিধানে নিয়েছিলাম, সেটি কি শুধু স্থগিতাদেশ আর নানা রকম সময়ক্ষেপণের সুযোগের কাছে মার খাবে? সেক্ষেত্রে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বনাম আব্দুল মোক্তাদির চৌধুরী (২০০১ ডিএলআর ৫৬৯) মামলায় বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের রায়টি কি যুগান্তকারী নয়? সংবিধানের চেতনা ভূলুণ্ঠিত করার জন্য স্বয়ং বিচারিক প্রক্রিয়ার অপব্যবহারকে (অনঁংব ড়ভ ঔঁফরপরধষ চৎড়পবংং) উচ্চ আদালত আর কতদিন প্রশ্রয় দেবেন? 

শুধু চূড়ান্ত আপিল নিষ্পত্তির দোহাই নয়। আপিল নিষ্পত্তির পর হয়তো আমরা শুনব, অপরাধের শাস্তি হয়েছে ঠিকই; কিন্তু অপরাধটি নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ নয় (৬৬(২)(ঘ)-এর দ্বিতীয়  পেঁচগি)! আমরা কিন্তু এইচএম এরশাদকে এই কাজটা করতে দেখেছিলাম (এইচএম এরশাদ বনাম জাহিদুল ইসলাম খান, ৫৪ ডিএলআর (এডি)১)। 

আমার মনে হয়, সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদ নিয়ে সাপ-লুডু খেলার এই দুর্বৃত্তায়ন ঠেকাতে উচ্চ আদালত Abuse of Judicial Process আর্গুমেন্ট জিনিসটা বিবেচনায় নিতে পারেন। Abuse of Judicial Process আর্গুমেন্টটা টর্ট-এর বিষয় মনে হলেও, আদালতের কাছে যাওয়ার গণঅধিকারের অপব্যবহারও এর আওতায় আসতে পারে।

লেখক, সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়




No comments:

Post a Comment

নতুন সংবিধান বিতর্ক: ১৯৭২ এর সংবিধানের “ত্রুটি”

নতুন সংবিধান বিতর্ক:  ১৯৭২ এর সংবিধানের “ত্রুটি” ড. এম জসিম আলী চৌধুরী  প্রভাষক আইন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব হাল, যুক্তরাজ্য  সিফাত তাসনীম আইন...