সাংসদ রুমিন ফারহানার প্রশ্ন ও একটি বিকল্প প্রস্তাব
এম জসিম
আলী চৌধুরী
সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও
সংসদ বিষয়ক
পিএইচডি গবেষক, কিংস কলেজ লন্ডন, যুক্তরাজ্য
লেখাটি দৈনিক প্রথম আলোর ১৬ই জুলাই ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত (লিংক)
প্রথম আলোর ১২ জুলাই সংখ্যার মতামত পাতায় মাননীয় সাংসদ ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা “কেমন চলছে মিনিটে ২ লাখ টাকা ব্যয়ের সংসদ?” শিরোনামে একটি প্রশ্ন তুলেছেন এবং এর উত্তরও দেয়ার চেষ্টা করেছেন। একটি আপাত সমাধান প্রস্তাবও মাননীয় সাংসদ দিয়েছেন। গবেষণার প্রয়াজনে গত চার বছর ধরে আমাকে জাতীয় সংসদের কার্যক্রম প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করতে হচ্ছে। সে সুত্রে সাংসদ ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার আলোচনা নিয়মিতই শুনি। বিভিন্ন অধিবেশনে দেয়া তাঁর নিজ দলীয় নীতি ও অবস্থান কেন্দ্রিক বক্তব্যগুলো নিয়ে গবেষক হিসেবে কোন মন্তব্য না করেও বলতে পারি, সাধারণভাবে প্রতিটি বক্তৃতার জন্য বিষয়ভিত্তিক ও তথ্য ভিত্তিক যে প্রস্তুতি তিনি নেন সেটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং সেটি আর দশজন সাংসদ হতে উনাকে আলাদা করার জন্য যথেষ্ট। সাংসদ রুমিন ফারহানার কলামের মুল বক্তব্য তিনটি।
প্রথমটি জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের সাধারণ আলোচনা প্রসঙ্গে। এ অংশে মাননীয় সাংসদ বাজেট প্রণয়ণে সরকারের “১ শতাংশ” তোষণ নীতিরও সমালোচনা করেছেন। সংসদ গবেষক হিসেবে সরকারের অর্থনৈতিক নীতি কৌশলের ব্যাপারে মন্তব্য না করতে চাইলেও সরল একটি প্রশ্ন হয়তো আমি মাননীয় সংসদকে করতে চাইবো। সেটি হচ্ছে, বর্তমান সরকারী দলের আলোচ্য অর্থনৈতিক নীতি কৌশলটি আদৌ মাননীয় সাংসদের নিজ দল বা জোটের অর্থনৈতিক নীতি কৌশলের চেয়ে ভিন্ন কিনা? বাজেট আলোচনায় “বাজেট” না থাকার প্রশ্নে অবশ্য মাননীয় সাংসদের সাথে দ্বিমতের সুযোগ নেই। গত তিন বছরের প্রতিটি বাজেট অধিবেশন পর্যবেক্ষণ করে আমিও তা-ই দেখেছি। তবে মাননীয় সাংসদ জেটি উলেখ করেননি সেটি হলো এ চিত্রটি শুধু গত তিন বছরের নয়। আমার পড়াশুনা বলছে, ক্ষমতাসীন দল নির্বিশেষে এটি কার্যত আমাদের পুরো সংসদীয় ইতিহাসেরই চিত্র।
আলোচনার দ্বিতীয় অংশে সংসদ সদস্যদের (বিশেষত সিনিয়র সদস্যদের) বিষয় বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে মাননীয় সাংসদের হতাশা লক্ষ্যনীয়। এ নিয়ে দ্বিমত করার সুযোগ নেই যে, আমাদের দেশে সে অর্থে পেশাদার পার্লামেন্টারিয়ান খুব বেশী নেই। আপাতদৃষ্টিতে রাজনীতিবিদদের পড়াশুনায় অনীহার কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে হলেও, সমস্যাটির মুলে রয়েছে সংসদের প্রাতিষ্ঠানিক সংকট যেটির ইঙ্গিত মাননীয় সাংসদের কলামে নেই।
নিবন্ধের তৃতীয় ও শেষ অংশে মাননীয় সাংসদ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অন্তত ট্রেজারি বিল (অর্থ বিল বা বাজেট) এর ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে দেয়ার সুযোগের কথা বলেছেন। গবেষক হিসেবে আমার মনে হয়েছে এ প্রস্তাবটি সম্ভবত কিছুটা তাড়াহুড়া করে এবং এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া স¤পর্কে গভীর চিন্তা-ভাবনা না করেই দেয়া। মাননীয় সাংসদ যখন সরকারের উপর অনাস্থা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে সাংসদদের নিজ দলের বিপক্ষে ভোট না দিতে পারাটা মেনে নিতে পারছেন তখন ধারণা করে নেয়া যায় যে, ৭০ অনুচ্ছেদের মুল যৌক্তিকতা (স্থিতিশীল সরকার) তিনি অনুধাবন করেন। সমস্যা হচ্ছে সংসদের বিরোধিতায় কোন সরকার ট্রেজারি বিল বা বাজেট পাশ করাতে ব্যর্থ হলেও কিন্তু “স্থিতিশীল সরকার” থাকার কথা নয়।
সংবিধানের ৮৩ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সংসদের আইন বা অনুমোদন ছাড়া জনগণের উপর এক পয়সার করারোপ করা রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। সংবিধানের ৮৫ ও ৯০ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সংসদের আইন বা অনুমোদন ছাড়া রাষ্ট্রীয় তহবিলের এক পয়সা উত্তোলন বা ব্যয় নির্বাহও সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি কোন বছরে সরকার সংসদ অনুমোদিত বরাদ্দের অতিরিক্ত ব্যয় করেও ফেলে সেটিও পরের বছর সংবিধানের ৯১ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংসদের মাধ্যমে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। অবশ্য কোন সরকার হয়ত সংবিধানের ৯২(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৬০ দিন পর্যন্ত কাজ চালিয়ে নিতে পারে। কিন্তু সংসদে বাজেট পাশ করানো ছাড়া এর বেশী সময় চালিয়ে নেয়ার আর কোন সরাসরি সুযোগ সংবিধানে নেই।
প্রসঙ্গক্রমে মাননীয় সাংসদ রুমিন ফারহানার নিজ দলের নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে জনাব জিয়াউর রহমান সংবিধানে ৯২ক অনুচ্ছেদ যোগ করেছিলেন। এটিতে বলা ছিলো কোন সংসদ বাজেট পাশ না করলে সেই সংসদ রাষ্ট্রপতি ভেঙ্গে দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে বাজেট পাশ না হলে সরকার পতনের বদলে সংসদের পতন ঘটতো। আশার কথা হচ্ছে, ৯২ক অনুচ্ছেদ এখন সংবিধানে নেই। তারপরও মাননীয় সাংসদের পরামর্শ মোতাবেক ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধিত হলে সংসদকে পাশ কাটিয়ে রাষ্ট্রপতির আদেশ বা অধ্যাদেশের মাধ্যমেই সরকার বাজেট দিয়ে দিতে পারবে। ধরা যাক, ৭০ অনুচ্ছেদের বাধা না থাকায় কোন সংসদে সরকারে বাজেট পাশ হলো না। সরকার প্রথমে ৯২(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির আদেশ দিয়ে ৬০ দিন চালিয়ে নিলেন। তারপর সংবিধানের ৭২(১) অনুচ্ছেদের আক্ষরিক বিধান মেনে আরো একটানা ৬০ দিন পর্যন্ত সংসদকে অধিবেশনের বাইরে রাখলেন। ইতোমধ্যে, সংবিধানের ৯৩(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমেই একটি বাজেট দিয়ে দিলেন। ৯৩(৪) অনুচ্ছেদ অনুসারে এ বাজেট সংসদ পরেরবার অধিবেশনে আসার ৩০ দিনের ভেতর পাশ করিয়ে নিতে হবে। এভাবে মোট ১৫০ দিন (৫ মাস) পর্যন্ত কাজ চালিয়ে নিয়ে সরকার যদি দেখেন সংসদ এখনো বাজেট পাশ করবে না, তাহলে প্রধাণমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙ্গে দিতে পারেন। আখেরে এসে দেখা যাচ্ছে, সেই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিলুপ্ত হওয়া ৯২ক অনুচ্ছেদই কার্যকর হলো। অতিরিক্ত হিসেবে সরকারেরও পতন হলো। সুতরাং দেখা যাচ্ছে সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য অনাস্থা প্রস্তাব এবং ট্রেজারি বিল (বাজেট) - দুটোই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একটির ক্ষেত্রে ৭০ অনুচ্ছেদ কার্যকর রেখে আরেকটিতে ছাড় দিলে কথিত “স্থিতিশীল সরকারের” লক্ষ্য পুরণ হয় না।
মাননীয় সাংসদ অবশ্য দাবী করছেন যে, বাজেটের বেলায় ৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দিলেই সাংসদরা তাৎক্ষণিক দলের বিপক্ষে ভোট দেয়া শুরু করবেন না। এর ফলে সরকার "পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ভীত থাকবে"। আমার মনে হয় সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে পুরো রাস্ট্রের ক্ষমতাকাঠামোতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি না করেও এ “ভীতি”টুকু সঞ্চার করা যায়।
আমাদের সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে বাজেট সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানোর বিধান নেই। ধারণা করা যায় বাজেট সময়মত পাশ করানোর তাগিদ থেকেই হয়তো এমন বিধান। অথচ ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থার সুতিকাগার ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও সংসদীয় কমিটির কাছে বাজেট পাঠাতে হয়। সেখানে বাজেট প্রণয়ন ও পাশের প্রক্রিয়াটি দুই ধাপে প্রায় ছয় মাস সময় নিয়ে করা হয়। সরকারের অর্থনৈতিক নীতির উপর সংসদীয় কমিটি পর্যায়ে এমন অর্ধ-বছর ব্যাপী পর্যালোচনার সুযোগ নিঃসন্দেহে সরকারকে কিছুটা “ভীত” করতে পারে। বাজেট প্রক্রিয়াকে দ্বিস্তওে বিন্যস্ত করে এবং বাজেট প্রস্তাব বিশেষায়িত সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠিয়ে আমরাও হয়ত সরকার ও আমলাতন্ত্রে কিছুটা “ভীতি” সঞ্চার করতে পারি। তাছাড়া একটি কার্যকর সংসদীয় কমিটি ব্যবস্থা মাননীয় সাংসদের উত্থাপিত আরেকটি সমস্যা (বিশেষজ্ঞ জ্ঞান) এরও কিছুটা সমাধান দিতে পারে।
সারা দুনিয়ার প্রায় সব সংসদের ক্ষেত্রেই মুল অধিবেশন কক্ষটি রাজনৈতিক বক্তব্যের লড়াইয়ের মঞ্চ হিসেবেই দেখা হয়। বলা হয় সংসদের চোখ-কান এবং হাত-পা হচ্ছে সংসদীয় কমিটিগুলো। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির অধ্যাপক কিথ ক্রেবিয়েল সংসদীয় কমিটিকে সংসদের জন্য নির্মোহ (রাজনৈতিক নয়) তথ্য এবং বিশেষজ্ঞ জ্ঞান সরবরাহকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অধ্যাপক এন্থনি কিং ১৯৭৬ সালে জার্মান, ফরাসী ও ব্রিটিশ সংসদের রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার উপর একটি তুলনামুলক গবেষণা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন, সংসদীয় কাঠামোতে শুধুমাত্র দলীয় দ্বান্ধিকতা (opposition)-ই সংসদের একমাত্র চেহারা নয়। সংসদের কাঠামো (structure) এবং এর প্রক্রিয়াগত (process) ব্যবস্থা এমনভাবে সজ্জিত হতে হবে যেখানে নির্দলীয় (non-party), আন্ত-দলীয় (inter-party), এবং অন্ত-দলীয় (intra-party) প্রক্রিয়ার সব কয়টি ধারা বিকশিত হয়। সংসদের মুল অধিবেশন কক্ষটি অনেকটাই দ্বান্ধিক চরিত্রের হলেও, এন্থনি কিং কমিটি ব্যবস্থাকে নির্দলীয়, আন্ত-দলীয়, এবং অন্ত-দলীয় মিথস্ক্রিয়ার স্থান হিসেবে দেখেছেন। দুঃখজনক বা¯বতা হচ্ছে গণতন্ত্র বিহীন এবং ব্যক্তিগত আনুগত্য ভিত্তিক রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার কারণে আমাদের সংসদীয় কমিটিগুলোতে ৭০ অনুচ্ছেদ না থেকেও আছে। আমাদের সাংসদদের বেলায় সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সীমিত। সরকারের নীতি বা আমলাতন্ত্রের জবাবদিহিতার প্রশ্নে সংসদীয় কমিটির গণ শুনানি বা গণ-তদন্ত করার চর্চা খুব একটা নেই। যে সব সরকারী আইন প্রস্তাব সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো হয় সেগুলোর ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মত নেয়া, মতগুলোকে রাজনীতি নির্মোহভাবে বিবেচনা করা এবং প্রয়োজনে গ্রহণ করার মানসিকতার অনুপস্থিতিতে আমাদের সংসদীয় কমিটিগুলো অধ্যাপক কিথ ক্রেবিয়েলর ভাষায় তথ্য ও বিশেষায়িত জ্ঞান সরবরাহকারী হিসেবে গড়ে উঠে নি।
সুতরাং সংসদের সমস্যা সমাধানের জন্য দরকার হবে মাননীয় সাংসদের নিজের দল সহ সব রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর গণতন্ত্র চর্চা এবং সংসদীয় কমিটি ব্যবস্থাকে কাজ করতে দেয়ার ব্যাপারে তাদের স্বদিচ্ছা ও ঐকমত্য। তারপরও অন্তত একজন মাননীয় সাংসদের তরফে সংসদ নিয়ে চিন্তা-উপলব্ধি আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক। এটি তাঁর নিজ দলের নীতি নির্ধারক ও সদস্য পর্যায়সহ সব রাজনৈতিক দলে ভেতরে সঞ্চারিত হলে সেটি জাতির জন্য সুখকর হবে।
No comments:
Post a Comment