ড. এম জসিম আলী চৌধুরী
প্রভাষক আইন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব হাল, যুক্তরাজ্য
সিফাত তাসনীম
আইন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি
৫ অগাস্টের পর হতে এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, সভা-সেমিনার, টক শো-তে ১৯৭২ এর সংবিধান বাতিলের পক্ষে যত যুক্তি এসেছে সেগুলো সবগুলোকে আমরা এক জায়গায় করার চেষ্টা করেছি। যুক্তিগুলো মোটামুটি দুই দাগের। একদিকে ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার বেশ কিছু “গলদ” এর কথা বলা হচ্ছে। অন্যদিকে ১৯৭২ এর সংবিধানের বিভিন্ন বিধানের সুনির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট অনেক “ত্রুটি”র কথা বলা হচ্ছে। তিন পর্বের এ লেখার প্রথম পর্বে আমরা সংবিধান প্রণয়নের “গলদ” যেগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে সেগুলো বিবেচনা করেছি। এ পর্বে আমরা ত্রুটিগুলো উপস্থাপন করে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। পরের পর্বে তুলে ধরবো কেন নতুন সংবিধানের ধারণাটি দেশের ভালোর চেয়ে ক্ষতি বেশি করবে।
১৯৭২ এর সংবিধানের বিভিন্ন বিধানের মোটামুটি ছয়টি “ত্রুটি” ধরা হয়েছে। এর কতগুলো আদর্শিক, কতগুলো ঢালাও এবং কতগুলো সুনির্দিষ্ট।
প্রথম যুক্তিটি একেবারে রাজনৈতিক এবং অনেকটা ঢালাও। বলা হচ্ছে “মুজিব বাদ” তথা ১৯৭২ এর সংবিধান ফ্যাসিবাদের আঁতুড় ঘর। ওই সংবিধান সংশোধন করে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঠেকানো যাবে না।
আমরা মনে করি এ যুক্তিটিতে ১৯৭২ এর সংবিধানের চার মূলনীতির প্রতি এক ধরণের বিতৃষ্ণা প্রকাশ পায়। আমরা আত্নবিশ্বাসের সাথে দাবী করি যে, ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরতন্ত্র “মুজিব বাদ”, সংবিধানের চার নীতি বা এগুলোর পরিবর্তিত কোন ভার্সন থেকে আসে না। ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরতন্ত্র আসে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার সংকট ও রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার গোঁড়ার গলদ থেকে। ফ্যাসিবাদের উত্থান ঠেকাতে হলে আমাদেরকে সাংবিধানিক কাঠামো ও দল ব্যবস্থার দিকে নজর দিতেহবে।
“মুজিব বাদ” প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য হলো, বাংলাদেশের সাংবিধানিক জুরিস্প্রুডেন্সে “মুজিব বাদ” নামের কোন ডক্ট্রিন পাওয়া যায় না। এটি সত্য যে, ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়নের সময় বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা সংবিধানের চার নীতিকে “মুজিব বাদ” হিসেবে তুলে ধরতেন। কিন্তু ১৯৭৫ এর চতুর্থ সংশোধনীতেই এই রাজনৈতিক শ্লোগানের মৃত্যু ঘটে। ১৯৮০-র দশকে রাজনীতিতে ফিরে আসার পর হতে আজ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে “মুজিব বাদ” শব্দটিকে মহিমান্বিত করা বা এমন কি এটাকে তাঁদের সিগনেচার রাজনৈতিক ডক্ট্রিন হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়নি। আমাদের সুপ্রিম কোর্টের ৫৩ বছরের জুরিস্প্রুডেন্স দেখলে দেখা যাবে, সেখানে নানা সময় “মুজিব বাদ” নয়, “সংবিধানের চার মুল নীতি”র কথা এসেছে। প্রশ্ন করা যেতে পারে, মুল সংবিধানের চার নীতিই আমাদের সব সমস্যার কারণ কিনা।
চার নীতির প্রথমটি, গণতন্ত্র, নিয়ে কারো প্রশ্ন নেই। দেশের সামরিক বা রাজনৈতিক, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি বা বিএনপি – কোন সরকারের আমলের কোন সংশোধনীতে এ নীতিটির উপর হাত দেয়া হয় নি। বিএনপি-র আমলে দ্বিতীয় মুল নীতি, সমাজতন্ত্র,-র সংজ্ঞা সীমিত করা হয়েছিলো। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সংজ্ঞাটাকে আগের জায়গায় নিয়ে গেলেও পশ্চিমা লিবারেল ধাঁচের ব্যক্তি মালিকানা ও মুক্তবাজার অর্থনীতির উপর দুই দলেরই অঘোষিত ঐকমত্য হয়ে গেছে। ১৯৭৫ এর পর হতেই বাংলাদেশ আর সমাজতান্ত্রিক দেশ নয়।
বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ বা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক থাকলেও ২০১১ সালের ১৫ সংশোধনীতে এসে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশী নাগরিকত্বের বাস্তবতাটি মেনে নিয়েছে। তাঁরা ১৯৭২ এর মুল সংবিধানের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে ফিরেনি। ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক চালু আছে। কিন্তু এখানেও দেখা যাবে, ২০১১ সালের ১৫তম সংশোধনীতে আওয়ামী লীগ ধর্ম নিরপেক্ষতার যে সংজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা করেছে, সেটি ১৯৭২ সালের সংজ্ঞার চেয়ে ভিন্ন। তাঁরা রাষ্ট্র ধর্ম, আল্লাহ্র উপর আস্থা বিশ্বাস, বিসমিল্লাহ, ইত্যাদি রেখে দিয়েছেন। ১৯৭২ এর মতো করে ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে সরাসরি নিষিদ্ধ বলেননি। এক ধরণের সমঝোতা ও পরিবর্তিত সময়ের বুঝ সেখানে স্পষ্ট।
এমতাবস্থায়, “মুজিব বাদ” এর মতো অতীতমুখী ধারণাকে সামনে এনে, ১৯৭২ এর সংবিধান ছুঁড়ে ফেলার যুক্তিটি অনেকটাই “র্যাডিক্যাল” ও অপ্রয়োজনীয় বিবেচিত হতে পারে। রাজনৈতিক আদর্শনিয়েতর্ক-বিতর্কএকটি চির চলমান প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক দলগুলো সময়ের সাথে সাথে একে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের দেশে এগুলো নিয়ে একসময় মাত্রা অতিরিক্ত ঝগড়া বিবাদ হয়েছে। ১৫-তম সংশোধনী পর্যন্ত আসতে আসতে দেখা যাচ্ছে, বিবাদের উত্তাপ অনেকটাই স্থিমিত।এসময় নতুন করে পুরোনো বিবাদ উস্কে দিলে বরং জাতীয় ঐক্য অর্জন পরাহতই হবে। আদর্শিক বিরোধকে উস্কে দিয়ে বা অপছন্দের আদর্শকে সমূলে উৎখাত করার চেষ্টা পৃথিবীর ইতিহাসে কখনোই সফল হয়নি। এ ধরণের চেষ্টা থেকেই বরং ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থানের আশংকা বেড়ে যায়।
দ্বিতীয় যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে ১৯৭২ এর সংবিধানে মৌলিক অধিকারের তালিকা আছে কিন্তু বাস্তবায়নের কোন পথনির্দেশ নেই যে কারণে ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট এর মতো কালো আইন হয়েছে।
আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানে আমরা দুনিয়ার বুকে এমন কোন সংবিধান পাইনি যেখানে মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের একশো’টা পথ বাতলে দেয়া হয়েছে। ১৯৭২ এর সংবিধানের ২৬, ৪৪ এবং ১০২ অনুচ্ছেদে বরং মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের বেশ শক্তপোক্ত পথ নির্দেশ করা আছে। এ অনুচ্ছেদগুলোর মাধ্যমে অহরহ মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন চ্যালেঞ্জ হয়েছে, বাতিল হয়েছে – ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, জননিরাপত্তা আইন তার কয়েকটা উদাহরণ। বিশেষ ক্ষমতা আইন, আইসিটি এক্ট, ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট, দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল আইনসহ অনেক আইন চ্যালেঞ্জ হয়নি অথবা এগুলোর অপপ্রয়োগ রোধে ফৌজদারি আদালত ব্যবস্থা ভূমিকা রাখতে পারেনি।
সেটার দোষ কার? রাজনৈতিক সরকারের, তাদের কুক্ষিগত করে রাখা আদালতের এবং তাঁদের অনুগত আইনজীবী সমাজের? নাকি ১৯৭২-এর সংবিধানের? সমস্যাটা কি এই সংবিধানের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে? নাকি অধস্তন আদালতকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার জন্য মূল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে দেয়া নির্দেশনা উপেক্ষা করার মধ্যে? তাছাড়া প্রস্তাবিত নতুন সংবিধানে মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের জন্য কি কি নতুন ব্যবস্থা থাকবে তার কোন ইঙ্গিতও পরিষ্কার নয়।
হতে পারে দেশে সাংবিধানিক আদালত ব্যবস্থা চালু হলো, অথবা সংসদে আইন প্রস্তাব আসার সময়ই এটাকে সুপ্রিমকোর্টের জুডিশিয়াল রিভিউ-র আওতায় আনার ব্যবস্থা আসলো (যেটি শ্রীলংকায় আছে)। কিন্তু এগুলোর কোনটার জন্যই ১৯৭২ এর মুল সংবিধান বাতিল করার দরকার নেই। সংশোধন করলেই চলে। অবশ্য সাংবিধানিক আদালত বা প্রি-লেজিসলেটিভ জুডিশিয়াল রিভিউও কাজ করবে না যদি প্রতিষ্ঠানগুলো চিরাচরিত নিয়মে দলীয়করণ হতে থাকে। সুতরাং সমস্যাটা ১৯৭২ এর সংবিধানের নয়। সমস্যাটা সংবিধান যারা মানে বা ছুঁড়ে ফেলে দেয় তাঁদের।
তৃতীয় যুক্তি হিসেবেও অনেকটা পাইকারি একটা কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আমাদের দেশে জনগণের ক্ষমতায়ন নেই। মাঝে মাঝে একটি নির্বাচন হলেও, নির্বাচনে ভোট দেয়া (যদি আদৌ দেয়া যায়) ছাড়া রাষ্ট্র ক্ষমতায় জনগণের অংশগ্রহণের কোন রাস্তা থাকে না।ফলে জনগণকে সংঘাতপূর্ণ বিপ্লব বা অভুথ্যান এর পথ বেছে নিতে হয়।
আমরা ঠিক নিশ্চিত নই এ যুক্তিতে ১৯৭২ এর সংবিধান বাতিল হয় কিভাবে। ১৯৭২ এর সংবিধানে নির্বাচন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কাঠামোটি ঠিক করে দেয়া হয়েছে। এর সাথে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো যোগ করা হয়েছে। ব্যবস্থাটি “অগণতান্ত্রিক” অজুহাতে বাতিল করে দেয়া হলেও, ওই বাতিল করাটাই বরং অগণতান্ত্রিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদালতের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবনের সুযোগ আছে। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা বেশ স্পষ্টভাবেই সংবিধানে আছে।কিন্তু প্রয়োগ হয়না। নানা নির্বাচনী আইনও সংস্কার করার সুযোগ আছে।
এর বাইরে, অংশগ্রহণমূলক সরকার বা জনপ্রশাসন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা অভ্যাসের ব্যাপার। যেমন, ১৯৭২ এর সংবিধানে জাতীয় সংসদকে জনগণের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবেই দেখা হয়েছে। সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে ও সংসদীয় কমিটিগুলোর কার্যক্রমে জনসম্পৃক্ততার ভালো সুযোগ রাখা হয়েছে। চর্চাটা রাজনৈতিক সরকারগুলো করছে না, সেটি ১৯৭২ এর সংবিধানের ত্রুটি নয়। ১৯৭২ এর সংবিধানের কোথাও জনগণের অংশগ্রহণমূলক সরকার ব্যবস্থার কথা কম বলা হলে সেটি সংশোধন করে আরো বেশি কিছু বলা যায় কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু এটিকে বাতিল করে নতুন আরেক সংবিধান নেয়া হলে সেটিই রাজনৈতিক দলগুলো অক্ষরে অক্ষরে মানতে শুরু করবেন এই অলীক কল্পনারই বা ভিত্তি কি?
চতুর্থ যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে ১৯৭২ এর সংবিধানের “অনেক ত্রুটি”। এটি এত বেশি কাটাছেঁড়া হয়েছে যে, এক দুই জায়গায় সংশোধন করে এটি ঠিক করা যাবে না। তার চেয়ে নতুন করে লিখাটাই ভালো।
বর্তমানে দেশে সংবিধান নিয়ে যেসব সভা-সেমিনার বা আলাপ-আলোচনা হচ্ছে সেখানে ঢালাও কথা এবং তাত্ত্বিক কথা বেশি বলা হচ্ছে। সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে বলা হচ্ছে না কোথায় কি করা দরকার। যদি দেখা যায় নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় সংশোধন করলেই হয় তাহলে সংবিধান সংশোধনই যথেষ্ট। আর যদি দেখা যায় সমস্যা একেবারে “সীমাহীন” তাহলে হয়তো বলা যাবে মূল সংবিধানটার “সবকিছুই” একেবারে অকেজো হয়ে গেছে। সুতরাং নতুন দরকার পড়ছে।
এক্ষেত্রে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ৩১-দফা “রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাব” আমরা পড়েছি। তাঁরা কিছু বিষয় একেবারে নির্দিষ্ট করেছেন। যেমন – প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুইবারের বেশি না, দুইকক্ষের সংসদ প্রতিষ্ঠা, ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে আমেরিকার মতো সংসদীয় কমিটির সামনে শুনানী, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ (এটির জন্য মুল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবন করলেই হয়), বিচারক নিয়োগ ও অপসারণে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন (এটিও মুল সংবিধানে বলা আছে) এবংস্থানীয় সরকারে হস্তক্ষেপ না করা (এটিও মুল সংবিধানেআছে)।আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিএনপি-র সবগুলো দফা একসাথে একবারে বাস্তবায় নকরতে গেলেও সংবিধান “নতুন করে লেখার” দরকার নেই। চিহ্নিত জায়গাগুলোতে সংস্কার করলেই চলে। বিএনপি-র পক্ষ থেকেও নতুন সংবিধানের কোন দাবী নেই। তারা বরং সংস্কারের কাজটিও নির্বাচিত সরকারের করা উচিত বলে মনে করেন।
পঞ্চম যুক্তিটি এখন পর্যন্ত যত যুক্তি দেয়া হয়েছে, তার ভেতর সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত এবং শক্ত যুক্তি। ১৯৭২ এর সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, ফলে রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামো ভারসাম্যহীন হয়ে গেছে।
আমরা এই যুক্তির বাস্তবতা উপলব্দি করি। ১৯৭২ এর সংবিধানের একটি বড় সমালোচনা হচ্ছে যে সংবিধান প্রণেতারা সংসদীয় ব্যবস্থার ভেতর সরকার প্রধানের ক্ষমতা বেশি দিয়েছেন। তবে গভীর বিবেচনায় এ সমালোচনাটিকে কিছুটা অপরিপক্ব বলে মনে হয়।১৯৭০ সালের এক পাবলিক লেকচারে লর্ড হেইলসাম ব্রিটিশ ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থাকে ‘প্রধানমন্ত্রীর স্বৈরতন্ত্র’ (Prime Ministerial Dictatorship) আখ্যা দিয়েছিলেন। ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থাটি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে স্বীকার করেই সাজানো। এ ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর উপর নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিতা আসে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, সংসদের বিরোধীদল, শক্তিশালী ও স্বতন্ত্র স্থানীয় সরকার, স্বাধীন বিচার বিভাগ, শক্তিশালী গণমাধ্যম ও জবাবদিহি নিশ্চিতকারী অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে।আমাদের মতো উপনিবেশ-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোতে জবাবদিহির এই বিকল্প রাস্তাগুলো বন্ধ থাকায় বা শক্তিশালী না হওয়ায় ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থার প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রিকতাটিকে অতিরিক্ত চোখে পড়ে।
তারপরও আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে কমাতে হলে কি করা যায়? এ প্রশ্নের উত্তরে নানা সময়ে দেখা গেছে সবাই রাষ্ট্ৰপতির ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেন। এখানে সমস্যা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতির সাথে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার সঙ্ঘাতের বিপদজনক নজির আমাদের আছে। অবিভক্ত পাকিস্তানে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ এর সাথে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, ফিরোজ খান নুন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির বিরোধে পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোই ভেঙ্গে পড়ে। ১৯৯০ এর দশকে পাকিস্তানে গোলাম ইসহাক খানের সাথে বেনজির ভুট্টো এবং ফারুক লেঘারির সাথে নওয়াজ শরীফ ও বেনজির ভুট্টোর সংঘাতে দেশটিমারাত্নক সাংবিধানিক সংকটে পড়ে যায়। ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার সাথে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমা সিংহের বিরোধে শ্রীলঙ্কাও খাঁদের কিনারে পৌঁছে যায়। এসব বিবেচনায় আমাদের দেশের সংস্কারগুলো সংসদীয় ব্যবস্থারমুল কাঠামো ঠিক রেখে করাটাই সঙ্গত।
কেউ দুই বারের বেশী প্রধানমন্ত্রীহতে না পারার প্রস্তাব আছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণ। আমাদের সরকারগুলো প্রতিষ্ঠান বা সংবিধানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়ার চেয়ে ব্যক্তি বা দলীয় প্রধান কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।১৯৭২ এর সংবিধানে রাজনৈতিক দলগুলোকে একেবারে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কেউ দুই বারের বেশী রাজনৈতিক দলের প্রধান হতে না পারার শর্ত থাকা উচিৎ। অন্যথায় পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা প্রধানমন্ত্রী না হয়েও সরকার চালাতে পারবেন। তাঁদের কথার বাইরে যাওয়া প্রধানমন্ত্রীকে দলীয় এমপি দিয়ে বিদ্রোহ করিয়ে ফেলে দিতে পারবেন। রাষ্ট্রপতি পদে কেউ দুই বারের বেশী না হওয়ার বিধানটাও রাখতে হবে। অন্যথায় হয়তো, প্রধানমন্ত্রী হতে না পারা নেতারা রাষ্ট্রপতি হয়ে ক্ষমতার কলকাঠি নাড়বেন। দলের ভেতরে নেতৃত্ব নির্বাচনটা দল প্রধানের বা পরিবারের ইচ্ছেয় না হয়ে, অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার গোপন ব্যালটে নির্বাচিত হওয়ার শর্ত থাকতে পারে। এ সবের কোন কিছুর জন্যই আমাদের একটি নতুন সংবিধানের দরকার নেই।
ষষ্ঠ যুক্তিটি বেশ জনপ্রিয়। বলা হয় সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ গণতন্ত্র বিরোধী এবং এটিই সব সমস্যার মুলে।
বাংলাদেশের প্রায় সবাই আমাদের সব সমস্যার জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদকে দায়ী করেন। সংবিধান প্রণেতারা সরকারের স্থিতিশীলতা রক্ষায় এর প্রয়োজনের কথা বলেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোও বিগত ৫৩ বছরে এ বিধানটি বাতিল করেন নি। ধারণা করা যায়, তাঁরাও সংবিধান প্রণেতাদের সাথে একমত।
এখন কেউ কেউ বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে সরকারের উপর অনাস্থা প্রস্তাবের ভোটাভুটিতে ৭০ অনুচ্ছেদ দরকার হলেও বাজেট ভোটাভুটিতে ৭০ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ হবে না এমন বিধান করা যেতে পারে। আমরা মনে করি এটির সমাধান এখানে নয়। কারণ সংসদের বিরোধিতায় কোনো সরকার বাজেট পাস করাতে ব্যর্থ হলেও সরকার পতন বা সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার অবস্থা তৈরি হতে পারে। তাছাড়া বাজেটে সরকারের বিরদ্ধে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা থাকলেই এমপি-রা ভোট দেবেন এমন নিশ্চয়তা নেই। ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদের প্রশ্নোত্তর, সংসদীয় বিতর্ক বা সংসদীয় কমিটির কার্যক্রমে প্রযোজ্য নয়। অথচ দেখা যায়, সেখানেও দলের এমপি-রা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন না। গণতন্ত্রবিহীন এবং ব্যক্তিগত আনুগত্যভিত্তিক রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার কারণে এসব জায়গায় ৭০ অনুচ্ছেদ না থেকেও আছে। কারণ সংসদ সদস্যদের পক্ষে দলের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরোধিতা করা বা সরকারের নীতির বিরোধিতা করা অনেকটাই রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ১৯৭২ এর সংবিধান বাতিল করে আরেকটি সংবিধান লিখে ফেললেই, এবং সেটাতে ৭০ অনুচ্ছেদ থাকলে বা না থাকলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যাটি আমাদের রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার ভেতরে, যেখানে গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, তৃণমূলের পছন্দে দলের মনোনয়ন লাভ বা নেতৃত্বের স্থানে উঠে আসার সুযোগ অনুপস্থিত। সংস্কারের প্রশ্ন আসলে এখানেই আসা উচিত।
পরের পর্বের আলোচনায় আমরা দেখাতে চেষ্টা করবো কেন নতুন সংবিধানের ধারণাটি আত্মঘাতী হতে পারে।