সমসাময়িক
জুকারবার্গের ফেসবুক, প্লেটোর রিপাবলিক ও সাক্ষ্য আইনের সহজ পাঠ
মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান daily suprobhat bangladesh 27 august 2012
link: http://www.suprobhat.com/details.php?reqDate=2012-08-27%2000:00:00&catId=1&subCatId=6&conId=21773
Also published in The Daily Azadi 30 August 2012
link: http://www.dainikazadi.org/index1.php?table=august2012&view=0&date=2012-08-30&menu_id=25&flag=1
একটি চমৎকার যাত্রার সূচনা
আইনজীবী ও বিচারকদের কাছে সাক্ষ্য আইন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রায়োগিক ও তত্ত্বগত উভয় দিক থেকে এটা সত্য। অধ্যয়ন ও চর্চার জন্য সাক্ষ্য আইন অত্যাবশ্যকীয় হলেও প্রয়োজনীয় বইয়ের অপ্রতুলতা রয়েছে। ভালো বইয়ের কথা বলাই বাহুল্য। ভালো বই যে নেই তা নয়। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব নগণ্য। ইংরেজি ভাষায় লিখিত বেশ কিছু ভালো বই আছে। তবে ভাষাগত প্রতিবন্ধকতার কারণে সে বইগুলো থেকে আইনের ছাত্ররা ও আইনজীবীরা প্রত্যাশিত উপকার পেতে সক্ষম হয় না। বাংলায় লেখা বিভিন্ন বই বাজারে আছে। সেগুলোকে খারাপ বলা যায় না। এই বইগুলোর কোন কোন অধ্যায় বা অংশ চমৎকারভাবে লিখিত। কিন্তু এই চমৎকার লিখিত অংশের পরেই দেখা যায়-মারাত্মক একটি ভূল। যা জুরিসপ্রুডেন্সের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গর্হিত। এ ধরণের ভূলগুলো বেশি হয় জুরিসপ্রুডেন্স ও বাংলা ভাষার জ্ঞানের সঠিক সমন্বয়ের অভাবে। এ কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের তরুণ শিক্ষক এম জসিম আলী চৌধুরীর ‘সাক্ষ্য আইন: সহজ পাঠ’ বইটি কৌতুহল সৃষ্টি করে। ধরে নিয়েছিলাম যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আইন বই লিখতে গিয়ে তিনি অন্ততঃ বাংলা ভাষার ভূল প্রয়োগ করবেন না। বইটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার এ ইতিবাচক ধারণার সাথে মিলে গেছে। পুরো বইয়ের প্রতিটি শব্দ যেন একটি চমৎকার যাত্রার একেকটি পদক্ষেপ।
সরল উপস্থাপনার ডিজিটাল আবেদন
প্রথম অধ্যায়ে সাক্ষ্য আইনের প্রাথমিক ধারণা দেয়া হয়েছে অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায়। যিনি আইনের ছাত্র নন তাঁর কাছেও বোধগম্য মনে হবে। সাক্ষ্য আইনের সংজ্ঞা, কার্যকারিতা, বৈশিষ্ট্য, উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, প্রয়োগ ও পরিধির সুন্দর ও সুসপষ্ট বিবরণ দেয়া হয়েছে এ অধ্যায়ে। ফৌজদারি ও দেওয়ানী মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইনের ভূমিকা এবং সাক্ষ্য আইন যথার্থভাবে প্রয়োগে আইনজীবীর দায়-দায়িত্ব বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন লেখক। লেখকের প্রচেষ্টা ও মনোভাব উন্নয়নমুখী বলে মনে হয়েছে। প্রচলিত বইগুলোতে আইনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের কথা বলা হয়। অথচ লেখক অত্যন্ত সচেতনভাবে উন্নয়নের উপর জোর দিয়েছেন। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ডিজিটাল যুগে তরুণ লেখকের এই সাহস আশা জাগায়।
খুলে গেল জ্ঞানের নবদ্বার
ধারা ভিত্তিক না করে বিষয় ভিত্তিক আলোচনা করায় শিক্ষার্থীদের সুবিধা হবে। যে ধারাগুলো পরসপর জড়িত এবং প্রাসঙ্গিক সে ধারাগুলোকে একই আলোচ্য বিষয়ের আওতায় এনে আলোকপাত করায় সাক্ষ্য আইন সবার জন্য সহজ ও সুখপাঠ্য হয়ে উঠবে। প্রত্যেকটি আলোচ্য বিষয়ের নামকরণের নতুনত্ব লেখকের সৃজনশীলতার পরিচায়ক। যা গতানুগতিক ধারার সাথে মিলে না। এটি বিচারক, আইনজীবী, শিক্ষার্থী বা সৌখিন পাঠকদের জন্য জ্ঞানের এক অভিনব দুয়ার খুলে দিতে পারে। লেখকের রচনাশৈলী ও আকর্ষণীয় শিরোনামগুলি আইন পঠনের পরিধিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করবে বলে আশা করা যায়।
সুপিরিয়র কমপ্লেক্স পরিহারে উদারতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগগুলোতে পশ্চিমা লেখকদের বইগুলোকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ভাষাগত সরলীকরণের কারণে ভারতীয় লেখকদের ইংরেজি মাধ্যমের বইগুলোও যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। অথচ আইন চর্চার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে বিষয়গুলোর সুসপষ্ট ধারণার জন্য বিখ্যাত আইনবিদ জনাব গাজী শামসুর রহমান ও শ্রী দীনেশ চন্দ্র দেব নাথ এবং সমচেতনার অন্যান্য লেখকদের বাংলায় লেখা বইগুলো প্রশংসনীয়ভাবে কার্যকর। এটা হলফ করে বলা যায় যে, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীদের অনেকেই এ বইগুলো পড়েন; কিন্তু লাল-নীল নিষিদ্ধ বইয়ের মত এ বইগুলোর কথা প্রকাশ করতে সংকোচ বোধ করেন। এটার কারণ আমার জানা নেই। তাঁরা হয়ত ভাবেন-অন্যরা আমাদের ‘ক্ষ্যাত’ (?) মনে করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বইগুলো পড়ার ব্যাপারে আমাদেরকে প্রচ্ছন্নভাবে অনুৎসাহিত করা হতো। এ কারণে ছাত্রজীবনে বইগুলো খুব একটা পড়া হয়নি। পরবর্তীতে পেশাগত জীবনে বিভিন্ন সমস্যার সহজ সমাধানে এগুলো প্রচণ্ডভাবে সহায়তা করেছে। বুঝতে পারছি ছাত্রাবস্থায় এই গুণী লেখকদের দূরে সরিয়ে খুব বেশি উপকৃত হইনি। এ ক্ষেত্রে জনাব জসিম মানসিক অচলায়তন ভেঙ্গে নাক উঁচা সুপিরিয়র কমপ্লেক্সের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন। এটা মানুষ হিসেবে তথা গবেষক হিসেবে তাকে অন্য উচ্চতায় সমাসীন করেছে।
জুকারবার্গের ‘ফেসবুক’ ও আমাদের আইনের ‘বসন্ত’
অনেকগুলো কাল্পনিক ঘটনাকে বক্স আইটেম করা হয়েছে। অনেকের কাছে এটা বেখাপ্পা মনে হতে পারে। তবে বৈশ্বিক পরিসরে চিন্তা করলে এটাকে স্বাভাবিক বলতে হবে। তাছাড়া আজকের বিদঘুটে বিষয় আগামীকালের ফ্যাশন বা স্টাইল। ফেসবুকের ‘ট্যাগ’ ও ‘শেয়ার’ দিয়ে ‘আরব বসন্ত’ এসেছে। প্রিয় কিংবা অপ্রিয় বিষয়গুলো সহজেই অন্যের নজরে আনার জন্য ‘ট্যাগ’ বা ‘শেয়ার’ করা হয়। এ বইয়ের বক্স আইটেমগুলো আমার কাছে ‘ট্যাগ’ বা ‘শেয়ার’ ছাড়া আর কিছুই নয়। বইটি কেবল বই-ই রইল না। এটা এর চেয়ে বেশি কিছু। যেন একটি ‘ফেসবুক’। আমাদের আইন শিক্ষার জগতে জনাব জসিম যেন জুকারবার্গের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। বাংলাদেশের আইন অঙ্গণে বসন্তের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
অষ্টম মহাদেশ আবিষ্কারের নেশা
দীর্ঘ আলোচনার প্রতিস্তরে দেশী-বিদেশী প্রাসঙ্গিক মামলার সিদ্ধান্ত উল্লেখ করা হয়েছে। আইনের প্রথম বর্ষের ছাত্রও জানে ব্যাপারটি কতটা কষ্টসাধ্য ও জটিল। আজকাল এত কষ্ট খুব কম লোকেই করতে চায়। লেখক ব্যতিক্রমী নজির সৃষ্টি করেছেন। সাদা জমিনের প্রচ্ছদে ‘আঙ্গুলের ছাপ’-খুবই অর্থপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বইয়ের পিছনের পিঠে স্মৃতিচারণ কতটা অসাধারণভাবে প্রাসঙ্গিক হতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তরুণ লেখক সমস্ত গতানুগতিক ধারা ভেঙে-চুরে নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে চান। এ যেন অষ্টম মহাদেশ আবিষ্কারের নেশা।
প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ ও নিষ্কলুষ ঋণের অকপট স্বীকৃতি
প্লেটোর শিক্ষক মহান গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের নিজস্ব কোন রচনা ছিল না। ভাববাদী দার্শনিক প্লেটো তাঁর শিক্ষকের ধ্যান ধারণাকে লালন করতেন। সক্রেটিসের চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ হল প্লেটোর ‘রিপাবলিক’। সক্রেটিসকে ছাপিয়ে প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ আজ বিশ্ব সাহিত্য ও মানব সভ্যতার এক গৌরবোজ্জ্বল অভিযাত্রার প্রতীক। ‘রিপাবলিক’ এর কৃতিত্ব প্লেটোরই। সক্রেটিসের কৃতিত্ব প্লেটোর মত ছাত্র গড়ে তোলায়। ‘সহজ পাঠ’-এর ভূমিকা পড়ে মনে হয়েছে লেখক কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত, কিছুটা আড়ষ্ট। প্রিয় শিক্ষক তথা সহকর্মী প্রফেসর ড. খবির উদ্দিন আহম্মদকে কোন কাজে সহায়তা করতে গিয়ে অর্জিত অভিজ্ঞতাকে নতুন আঙ্গিকে তুলে এনে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন তিনি। এর মধ্যে গৌরব আছে, লজ্জা নয়। তাছাড়া লেখকের ভূমিকায় কোন অসপষ্টতা নেই। ওখানে কৃতজ্ঞতা আছে, আছে ঋণ স্বীকার। এই স্বাভাবিক উদারতাটুকু অনেকেই দেখাতে চান না। সুতরাং দ্বন্দ্ব-সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। বইটির কৃতিত্ব কেবলই লেখকের। আর খবির স্যারের কৃতিত্ব জনাব জসিমের মত ছাত্র সৃষ্টিতে। লেখক একদিকে বিনয়ী ছাত্র, অন্যদিকে প্রেমময় সহকর্মী।
খবির স্যার ও ডি রোজারিও : একই সূত্রে বাঁধা
ডি রোজারিও অল্পকাল বেঁচে ছিলেন। কিন্তু এই ক্ষণজীবী ইউরেশিয়ান যুক্তি ও তর্কের আলোকে সর্ব সংস্কার-বন্ধনহীন স্বাধীন ও মহিমাদীপ্ত মানুষের যে আদর্শ তাঁর ছাত্রদের হৃদয়পটে এঁকেছিলেন তার ফলে তাঁরা অনেক সময় যে উচ্ছৃঙ্খল বিদ্রোহের আশ্রয় নিয়েছিলেন তাকে রবীন্দ্রনাথ প্রলয় বলে অভিহিত করেছেন। এই প্রলয়েরই সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান মাইকেল মধুসূদন। উপরের এ কথাগুলো বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক ও সমাজ বিজ্ঞানী ড. অনুপম সেনের। যা হোক রবি ঠাকুর যে প্রলয়ের কথা বলেছেন তা ইতিবাচক ছিল। খবির স্যার আইনের ছাত্র ছিলেন। আইন পড়িয়েছেন। আইনী আবহের স্বাভাবিক সীমাবদ্ধতা ও শৃঙ্খলায় আবদ্ধ থেকেও তিনি প্রলয় সৃষ্টিকারী। লেখক সে প্রলয়েরই ফল। প্রথাগত আইন শিক্ষার জগতে তিনি ইতিবাচক সুনামি হয়ে আবির্ভূত হবেন। প্রার্থনা করি - অনিবার্য ঈর্ষা যেন লেখককে হতোদ্যম না করে।
লেখক : যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস। বর্তমানে ডেপুটেশনে সচিব, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন।
get image of the write up
No comments:
Post a Comment