বিচারক অপসারণ বিতর্কে সমাধান সুত্র
এম. জসিম আলী চৌধুরী
দৈনিক সমকাল, "মুক্তমঞ্চ", ১৮ জুলাই ২০১৭
(আজকের দৈনিক সমকালের "মুক্তমঞ্চ" পাতায় প্রকাশিত। স্থান সংকুলানের স্বার্থে লেখাটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিতে হওয়ায় এখানে আমার মূল লেখাটি সহ সমকালের লিংক তুলে দিচ্ছিঃ http://bangla.samakal.net/2017/07/18/309015)
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ প্রশ্নে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেয়া সর্বসম্মত রায়টি জনমনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সচেতন মহলেও এটি এক ধরণের অবচেতন সন্তুষ্টি (complacency) সৃষ্টি করতে পেরেছে। বাংলাদেশের সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসের সাদামাটা মূল্যায়ন করতে গেলেও দেখা যাবে প্রায়শই সরকারী দলের একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ভরপুর জাতীয় সংসদ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মানুষের কাঙ্ক্ষিত শ্রদ্ধা ও আস্থা অর্জন করতে পারেন নি। এর পেছনে সংসদ সদস্য হিসেবে অতীতে দায়িত্ব পালন করেছেন, বর্তমানে করছেন এবং নিকট ভবিষ্যতে করতে পারেন এমন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা, চিন্তা, কর্ম এবং সুনামের সংকটই মুলত দায়ী। অতএব, আপিল বিভাগের রায়ের পর সংবিধানের জটিল মার-প্যাঁচ না জানা সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আইনজ্ঞ মহলের বিশাল একটি অংশও স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলছেন। সংবিধানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে অবশ্য ষোল সংশোধনীর আলোচনা অনকেটাই বৈপরীত্যে ভরপুর। বৈপরীত্যের কথা বলতে গিয়েও স্বস্থি নেই। শ্রোতারা অনেকেই আমাদের "তাত্ত্বিক" বলছেন এবং "বাস্তবতা" উপলব্ধি করার ব্যর্থতার অভিযোগ আনছেন। এ নিবন্ধে "তাত্ত্বিক" বৈপরীত্যগুলো সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো। তবে বাস্তবতার প্রশ্ন দিয়েই আলোচনা শুরু করতে চাই।
বিচার বিভাগের অবস্থানের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিঃ
মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায় এবং আপীল বিভাগে মামলার শুনানির ধারা পর্যালোচনা করে আমার মনে হয়েছে, ষোল তম সংশোধনী নিয়ে বিচার বিভাগের অবস্থানের পেছনে দুটি সুনির্দিষ্ট মনস্তাত্ত্বিক কারণ অন্য যে কোন ধরণের সাংবিধানিক এবং আইনি যুক্তিবোধের উপরে স্থান পেয়েছে। প্রথম কারণটি আগেই বলেছি - প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংসদ ও ব্যক্তি হিসেবে সংসদ সদস্যের ব্যাপারে বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবী এবং বিচারকদের আস্থাশীল হতে না পারা। দ্বিতীয় কারণটি অবশ্য জনগণের সামনে খুব বেশি আসে নি। সেটি হচ্ছে বিচারক অপসারণের আগের ব্যবস্থা (জুডিশিয়াল কাউন্সিল)-টিতে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র বিচারকদের একটি সুনিশ্চিত (guaranteed) ও গতি নির্ধারক (decisive) অংশগ্রহণ ছিল, যেটি ১৬-তম সংশোধনীর মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা মূল ব্যবস্থা (সংসদীয় অপসারণ)-টিতে নিশ্চিত নয়। বিচারক অপসারণ প্রক্রিয়ায় জ্যৈষ্ঠ বিচারকদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়াটা উচ্চ আদালতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সুপ্রিম কোর্টের এ মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান আমরা আগেই দেখতে পেয়েছি। পঞ্চম সংশোধনী মামলা (15 MLR (AD) 249)-য় সামরিক শাসক মেজর জিয়ার প্রায় সব সংশোধনী বাতিল করে দেয়া হলেও বিচারক অপসারণের জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থাটি রেখে দেয়া হয়। বিস্তারিত যুক্তি তর্কে না গিয়ে আপিল বিভাগ শুধু বলেছিলেন পরিবর্তিত ব্যবস্থাটি আগের ব্যবস্থার চেয়ে অধিকতর স্বচ্ছ (more transparent) এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার স্বপক্ষে (safeguarding independence of judiciary) (পূর্ণাঙ্গ রায়ের ১৭৭ দেখুন)। এরকম এক লাইনের ব্যাখ্যা দিয়ে মূল সংবিধানের একটি গুরত্বপূর্ণ পরিবর্তনকে মেনে নেয়ার সমালোচনা তখন অনেকেই করেছিলেন। তবে ১৬-তম সংশোধনী মামলার রায়ে আদালত তাঁর আগের অবস্থান ধরে রেখেছেন এবং বিস্তারিত ব্যাখা দেয়ার সুযোগও পেয়েছেন। দেখার বিষয় হচ্ছে, এবারের বিস্তারিত ব্যাখ্যা কতটুকু যুক্তিনির্ভর আর কতটুকু ধারণা (perception) নির্ভর। কারণ সাংবিধানিক মামলার বিচারে ধারণা ও যুক্তি-র ফারাক করা খুব জরুরী।
সংসদীয় অপসারণ ব্যবস্থা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে বলে মহামান্য আদালত এবং সম্মানিত এমিকাস কিউরিরা "মনে করলেই" ব্যবস্থাটি অসাংবিধানিক হয়ে যাবে না। দেখতে হবে সংবিধানে যে সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়েছে সে সব প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ও ভারসাম্য রক্ষার প্রক্রিয়ায় জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অনির্বাচিত বিচারকদের নিয়োগ ও অপসারণে "সাংবিধানিকভাবে অংশ নিতে পারেন কি না"। মহামান্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত না হওয়ায় আমি মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের ভিত্তিতেই ব্যাপারটি মূল্যায়ন করতে চাই। সুবিধা হচ্ছে, সম্মানিত এমিকাস কিউরি এবং পক্ষ বিপক্ষের আইনজীবীরা উভয় আদালতে মোটামুটি একই বক্তব্য দিয়েছেন এবং আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের রায় সমর্থন করেছেন। মাননীয় এটর্নি জেনারেলের একটি নতুন যুক্তি ছাড়া আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের শুনানি মোটামুটি একই রকম।
সাংবিধানিক মামলার বিচারে জনমতের প্রভাবঃ
হাইকোর্ট বিভাগে সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের আগাগোড়া পড়লে দেখা যায় মহামান্য আদালত এবং বিজ্ঞ এমিকাস কিউরিদের যুক্তি-তর্কের সিংহভাগ জুড়ে ১৬তম সংশোধনীর পেছনে রাজনৈতিক সরকারের (অসৎ) উদ্দেশ্য এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণেèর ব্যাপারে সাধারণ মানুষের অনুভূতি-ই প্রাধান্য পেয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, ১৬তম সংশোধনী যদি জনগণের দৃষ্টিতে (in public perception) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণè করে তাহলে আদালত তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন (হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের ১৩৯ পৃষ্টা দেখুন)। সংবিধান বিশারদ Geoffrey Rivlin তাঁর Understanding the Law (Oxford, Sixth Edition (2012)) বইয়ের ৮৪ পৃষ্ঠায় আইনের আদালতে এ ধরণের জনগণ তাড়িত বিচার (justice by plebiscite)-কে পরিতাজ্য বলেছেন। গণতন্ত্রে জনগণের মর্জি বুঝে চলার দায় জনপ্রতিনিধিদেও, বিচারকদের নয়। সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার করা পঞ্চম সংশোধনীর ব্যাপারে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা জিয়ার জনসমর্থনের যুক্তি তুলে ধরলে বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর রায়ের ২০৪ পৃষ্ঠায় বলেছিলেন, "আদালত গণভোটের ভিত্তিতে বিচার করেন না, আইনের ভিত্তিতে করেন" (2006 (Special Issue) BLT (HCD))। সম্ভবত একই কারণে জেনারেল এরশাদের করা হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণের সংশোধনীটি জনপ্রিয় হওয়া সত্বেও সুপ্রিম কোর্ট অসাংবিধানিক বলে রায় দেন। এখন নৈতিক প্রশ্ন হচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট বিকেন্দ্রিকরণের প্রশ্নে জনবিমুখী অবস্থান নেয়া বিচার বিভাগ আবার বিচারকদের চাকুরীর শর্ত স¤পর্কিত প্রশ্নে জনমতের আশ্রয় নিতে পারেন কিনা। আমরা বিশ্বাস করি, সংবিধান সংশোধনীর মত তাৎপর্যপূর্ণ একটি আইনকে অবৈধ বলতে হলে শুধুমাত্র সাংবিধানিক ও আইনি যুক্তির উপর দাড়িয়েই বলতে হবে, জনমত বা অন্যকোন কিছুর ভিত্তিতে নয়।
সাংবিধানিক মামলার বিচারে ধারণা ও যুক্তির ফারাকঃ
এ মামলার আরেকটি লক্ষ্যণীয় দিক হচ্ছে, আবেদনকারী আইনজীবী এবং বিশেষ করে সম্মানিত এমিকাস কিউরিরা ১৬তম সংশোধনী কায়েম হলে অদূর ভবিষ্যতে সংসদ ও সংসদ সদস্যদের সম্ভাব্য আচরণ কেমন হতে পারে তার ব্যাখ্যা দিতেই প্রায় পুরো সময় পার করেছেন। পত্র-পত্রিকা মারফত আপিল বিভাগে সিনিয়র আইনজীবীদের যে বক্তব্য পেয়েছি তার প্রায় পুরোটাকেই আমার আইনি যুক্তিতর্কের বদলে জনসমাবেশের বক্তৃতা বলে মনে হয়েছে। সিনিয়র আইনজীবী এবং মহামান্য বিচারকরা বলতে চেয়েছেন - সংসদ সদস্যদের ৭০ ভাগ ব্যবসায়ী, তাঁরা তাদের সংসদীয় কাজে মনোযোগী নন (হাইকোর্টের রায়ের ৪৫ পৃষ্টা), আইন প্রণয়নে তাঁদের দক্ষতা নিচু মানের (হাইকোর্টের রায়ের ১৪৬ পৃষ্টা), তাঁদের অনেকেরই ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড আছে (হাইকোর্টের রায়ের ৫০ পৃষ্টা) এবং ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে তাঁরা স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম (হাইকোর্টের রায়ের ৪৯ পৃষ্টা), ইত্যাদি। সন্দেহ নেই, জনমানসে এ ধরণের যুক্তি বেশ আকর্ষণীয় এবং জনপ্রিয় হবে। কিন্তু সমস্যা হল আইনের আদালতে আইনের বিচার কেবলমাত্র আইনের মাপকাঠিতেই হতে পারে, জনপ্রিয় ধ্যান-ধারণা (populist dogma)- র ভিত্তিতে নয়। তাছাড়া এ ধরণের জনপ্রিয় যুক্তি আমাদের সমাজের প্রায় সবক্ষেত্রেই খাটবে। আমাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রচুর নিম্মমানের ও নিচু নৈতিকতার শিক্ষক আছেন। আমাদের প্রশাসনে প্রচুর অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা আছেন। অতি নিম্মমানের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবীরাও আমাদের সমাজে আছেন। অথচ আমরা কেউ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বিচারালয়, প্রশাসন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প কলকারখানাা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি গণঅনাস্থা জ্ঞাপন করে সেখান থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছি না।
সাংবিধান ব্যাখ্যায় "প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি"র গুরুত্বঃ
অথচ যুক্তির কথা হচ্ছে ১৬তম সংশোধনীর বিচার হবে সাধারণ্যে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির বদলে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় সংসদের সংবিধানিক ক্ষমতা ও এখতিয়ারের প্রশ্নে। সংসদ সদস্যরা ব্যক্তি হিসেবে কতটুকু ভালো বা কতটুকু মন্দ সেটি এ মামলার বিচার্য হতে পারেনা। সাংবিধানিক আইনের লিটারেচারে আমরা একে "প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গী" বা "প্রাতিষ্ঠানিকতা" (institutionalism) বলি। ক্ষমতার পৃথকীকরণ ও ভারসাম্যনীতির আধুনিক রূপকার হচ্ছেন আমেরিকান সংবিধানের অন্যতম জনক জেমস ম্যাডিসন। ম্যাডিসন তাঁর ফেডারেলিস্ট পেপার ৫১-তে বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠান দিয়ে ব্যক্তির উচ্চাবিলাস নিয়ন্ত্রণ করা হবে। আবার প্রতিষ্ঠানের উচ্চাভিলাষ নিয়ন্ত্রণ করা হবে অপর একটি প্রতিষ্ঠানের সাংঘর্ষিক অভিলাষের মাধ্যমে (ambition must be checked by counter ambition)।
লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হচ্ছে, মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে আবেদনকারী আইনজীবী, বিজ্ঞ সিনিয়র এমিকাস কিউরি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের পুরোটা জুড়েই সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদে (২২ অনুচ্ছেদ) বলা ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতিকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। অন্যদিকে সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগ (মৌলিক নীতিমালা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতা ও বিচার বিভাগের অক্ষমতা), তৃতীয় ভাগ (মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে বিচার বিচাগের ক্ষমতা ও সংসদের অক্ষমতা), চতুর্থ ভাগ (সংসদ ও বিচার বিভাগের কাছে নির্বাহী বিভাগের দায়বদ্ধতা), পঞ্চম ভাগ (আইন প্রণয়ন, বাজেট অনুমোদন এবং রাষ্ট্রের অন্য অঙ্গগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে সংসদের ক্ষমতা) এবং ষষ্ঠ ভাগ (মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে ও আইনের প্রয়োগে বিচার বিচাগের ক্ষমতা)-এর সামগ্রিক পাঠে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পার¯পারিকতার যে কাঠামোগত অবয়ব (structural shape) লক্ষ্যনীয় হয় সেটিকে স¤পূর্ণ অবজ্ঞা করা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে বিচার বিচাগের ব্যাপারে সংসদের নাক গলানো (poking of nose) ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘন (হাইকোর্টের রায়ের ৪৫ পৃষ্টা)। সংসদের অভিশংসন বিচারের ক্ষমতাকে বিচারিক কর্ম আখ্যা দিয়ে রিট আবেদনকারীর আইনজীবী দাবি করে বসেন যে সংবিধান অনুযায়ী সংসদের এ ধরনের বিচারিক কাজ করার সুযোগ নেই। সংসদের কাজ শুধুই আইন প্রণয়ন এবং সংবিধান রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের ভেতর নিশ্চিদ্র পৃথকীকরণ (water tight separation) এর পক্ষে (হাইকোর্টের রায়ের ২৪ পৃষ্টা)! অথচ স্বয়ং মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের ক্ষেত্রেও জাতীয় সংসদ এ ধরণের "বিচারিক কর্ম" স¤পাদন করেন এবং সেটি সংবিধান সম্মতভাবেই। তাছাড়া আইন প্রণয়নের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় কোষাগার রক্ষণ এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে সংসদের সরাসরি ভূমিকা ব্রিটিশ সংসদীয় গণতন্ত্রের মূলমন্ত্রও বটে। সন্দেহ নেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বাংলাদেশ সংবিধানের একটি মৌলিক কাঠামো। প্রশ্ন আসে, ৭ম অনুচ্ছেদ তথা জনগণের সার্বভৌমত্ব কি সবচেয়ে বড় মৌলিক কাঠামো নয়? সংবিধানের একটি মৌলিক কাঠামোকে অতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্যান্য মৌলিক কাঠামোগুলোকে অবজ্ঞা করা এবং এদের মধ্যে ভারসাম্য সাধনের চেষ্টাকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে ব্যাখ্যা করা সংবিধান ব্যাখ্যার সঠিক পদ্ধতি বলে বিবেচিত হতে পারে না। দুঃখজনকভাবে, ১৬তম সংশোধনী মামলার কোন এমিকাস কিউরি ক্ষমতার ভারসাম্য নীতিকে বিবেচনায়ই ধরেন নি। শ্রদ্ধেয় ডঃ কামাল হোসেন স্যার সহ প্রায় সব এমিকাস কিউরি বিচারকদের অভিশংসন প্রক্রিয়ায় সংসদের প্রস্তাবিত অংশগ্রহণকে ভারসাম্য (check and balance) হিসেবে না ধরে হস্তক্ষেপ (interference) হিসেবে দেখিয়েছেন (হাইকোর্টের রায়ের ৩৯ পৃষ্টা)। মাননীয় এটর্নি জেনারেল ভুলটি ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও সেটি কেঊ গায়ে মাখেন নি (হাইকোর্টের রায়ের ২৮ পৃষ্টা)।
অথচ সংবিধানের ৯৫(২) অনুচ্ছেদ দেখলে দেখা যাবে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদের। এ কথা সত্যি যে সংসদ এখনো আইন করেন নি বলে ক্ষমতাটি নির্বাহী বিভাগ প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শক্রমে চর্চা করছে। কিন্তু সংসদ আজই আইন প্রণয়ন করে বলতে পারেন, প্রধান মন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির পরামর্শক্রমে বঙ্গভবন কর্তৃক মনোনীত বিচারকদের সংসদের অনুমোদন (confirmation) সাপেক্ষে চূড়ান্ত নিয়োগ দিতে হবে। সংসদ তেমন একটি আইন করলে সেটি ৯৫ (নিয়মিত বিচারক) এবং ৯৮ (অতিরিক্ত বিচারক) অনুচ্ছেদের কোন কিছুর সাথেই সাংঘর্ষিক হবে না। প্রশ্ন আসে সংসদ যদি সাংবিধানিকভাবেই বিচারক নিয়োগে অংশগ্রহণ করতে পারে তাহলে অপসারণে কেন নয়?
সংবিধানের সামগ্রিক পাঠে আরও একটি ব্যাপার লক্ষ্যনীয়। সংসদ প্রণীত আইনের বৈধতা বিচারের ক্ষমতা বিচার বিভাগের। মৌলিক কাঠামো নীতি প্রচলনের পর সংবিধান সংশোধনের বৈধতা যাচাই করার ক্ষমতাও বিচার বিভাগের। আমাদের দৃষ্টিতে এটি ভারসাম্য (check and balance) নীতির প্রয়োগ। অথচ বিচার বিভাগের কোন কিছুতে সংসদের অংশগ্রহণের প্রশ্ন আসলেই আমরা বলছি হস্তক্ষেপ (interference)! মূল সংবিধান কিন্তু যথার্থ অর্থেই বিচার বিভাগকে সংসদের আইনের বৈধতা বিচারের ভার দিয়েছেন আর বিপরীতে সংসদকে বিচারক নিয়োগ এবং অপসারণে ভূমিকা রাখার সুযোগ দিয়েছেন (মূল সংবিধানের ৯৫ ও ৯৬ অনুচ্ছেদ)। বাংলাদেশে ক্ষমতার পৃথকীকরণ আছে, ভারসাম্যও আছে। ভারসাম্য সাধনের কোন চেষ্টাকে হস্তক্ষেপ বলে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই। বিশেষত মূল সংবিধানে দেয়া কোন ভারসাম্যমূলক বব্যস্থাকে ঐ সংবিধানেরই মৌলিক কাঠামের পরিপন্থী বলার চেষ্টা যুক্তিসঙ্গত নয়। আপাতত আমরা আপিল বিভাগে এটর্নি জেনারেলের দেয়া এ যুক্তিটি প্রসঙ্গে মহামান্য আপিল বিভাগ কি বলেন সেটি দেখার অপেক্ষায় থাকতে পারি।
প্রিয় পাঠক, এ নিবন্ধের শুরুতে ১৬তম সংশোধনী প্রশ্নে উচ্চ আদালতের অবস্থানের পেছনে দুটি নির্দিষ্ট মনস্তাত্ত্বিক কারণ দেখিয়েছিলাম - এক, প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংসদ এবং ব্যক্তি হিসেবে সাংসদদের ব্যাপারে বিচার বিভাগের আস্থাহীনতা এবং দুই, উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের মত ¯পর্শকাতর প্রক্রিয়ায় সিনিয়র বিচারকদের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা চাওয়া। নিবন্ধের এ অংশে সংবিধানের প্রাতিষ্ঠানিক এবং কাঠামোগত ব্যাখ্যার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছি তাতে ¯পষ্ট হয় যে, উচ্চ আদালতের এ দুটি মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা বাদ দিলে শুধু সংবিধান ও আইনের আশ্রয় নিয়ে এ রায়কে সমর্থন করা আমাদের মত সংবিধানের শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কঠিন।
সংকটের সমাধান সুত্রঃ
প্রশ্ন আসে, ১৬ তম সংশোধনী বহাল রেখেও কি উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারকদের এ দুটি মনস্তাত্ত্বিক অস্বস্তি দূর করা যেত? আমরা বিশ্বাস করি তা করা যেত। দৈনিক পত্রিকার সাধারণ পাঠকদের উদ্দেশ্যে লিখছি বলে খুব বেশী জটিল আইনি বিশ্লেষণে যাচ্ছি না।
প্রথমত, আমার মতে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদ সদস্যরা দলীয় প্রধানের কাছে জিম্মি থাকাটা এ মামলার মূল সমস্যা নয়। কারণ বর্তমান বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে অপসারণ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি কি করবেন না করবেন তার প্রায় পুরোটাই দলীয় প্রধান (প্রধান মন্ত্রী)-র কাছে জিম্মি। সংসদ সদস্যদের জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ যা রাষ্ট্রপতির জন্য ৪৮(৩) অনুচ্ছেদও তা। দলবদ্ধ সংসদ সদস্যরা বরং একজন মাত্র রাষ্ট্রপতির চেয়ে বেশী স্বাধীন। তারপরও বিচারক অপসারণের প্রক্রিয়াকে অধিকতর স্বচ্ছ করার স্বার্থে এ প্রক্রিয়ার ভোটাভুটির সময় ৭০ অনুচ্ছেদকে সীমিত করার লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করা যেত। বিচারক অপসারনে আইন কমিশনের প্রস্তাবিত আইনের খসড়াটিতে আমরা সে ধরনের একটি সুযোগ দেখেছি। আমরা বিশ্বাস করি, ১৬ তম সংশোধনীকে অক্ষুণè রেখে উচ্চ আদালত প্রস্তাবিত আইনটির জন্য অপেক্ষা করতে পারতেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণèকারি কিছু দেখলে আইনটিকেই অসাংবিধানিক ঘোষণা করার সুযোগ ছিল। মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ অবশ্য অপেক্ষা করতে রাজি হন নি। বলেছেনে বিচারক অপসারণ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণকারি আইন হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই, মূল সংবিধানের এ বব্যস্থাটি নিজেই (in itself) অসাংবিধানিক ((হাইকোর্টের রায়ের ৬৭ পৃষ্টা)।
দ্বিতীয়ত, সংসদীয় অপসারণ প্রক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র বিচারকদের নিশ্চিত (guaranteed) ও গতি নির্ধারক (decisive) অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই ছিল এ মামলার মূল সমস্যা। মূল সংবিধান বা ১৬তম সংশোধনীর ৯৬ অনুচ্ছেদের কোথাও বিচারকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তে উচ্চ আদালতের সিনিয়র বিচারকদের অংশগ্রহণ বারিত করা হয় নি। ৭০ অনুচ্ছেদের সমস্যার মত অংশগ্রহণের এ সমস্যাটিও আইনের মাধ্যমে সমাধান করা যেত। বিডিআর বিদ্রোহের বিচারের আইনের মত প্রস্তাবিত অভিযোগ তদন্ত আইনের রূপরেখা চেয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে একটি ১০৬ অনুচ্ছেদের রেফারেন্স পাঠাতে পারতেন। সরকার এবং রাজনৈতিক শক্তির সদিচ্ছা থাকলে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টকে আশ্বস্ত করার অনেক পথই খোলা ছিল। দুঃখের কথা হল, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পার¯পারিক সন্দেহ এবং রাজনৈতিক জেদাজেদির খপ্প্ররে পড়ে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত এবং আইন সভা মুখোমুখি অবস্থানে দাড়িয়ে গেল।