Thursday, September 30, 2021

তাসনীম সিদ্দিকীকে সংসদীয় কমিটিতে তলব উদ্বেগজনক




এম জসিম আলী চৌধুরী

দৈনিক প্রথম আলো (৩০ সেপটেম্বর ২০২১) উপ-সম্পাদকীয় পাতা


প্রথম আলোর অন লাইন লিংকঃ
https://www.prothomalo.com/opinion/column/%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%AE-%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%80%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%B8%E0%A6%A6%E0%A7%80%E0%A7%9F-%E0%A6%95%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%A4%E0%A6%B2%E0%A6%AC-%E0%A6%89%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%97%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A6%95


০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে প্রথম আলোয় প্রকাশিত অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী-র সাক্ষাৎকারটি মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। অধ্যাপক সিদ্দিকী রেমিট্যান্স প্রবাহ বা এর প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত কোন পরিসংখ্যানকে সরাসরি অস্বীকার করেন নি। তিনি তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রবসী আয় নির্ভর পরিবারগুলোর যাপিত জীবনের সাথে সরকারি পরিসংখ্যানের চোখ ধাঁধানো সংখ্যার অমিল দেখেছেন। সে সুত্রে সাক্ষাৎকারটিতে পরিসংখ্যানের গাণিতিক অংকগুলো নিয়ে উনার কিছুটা সন্দেহগ্রস্থতা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি অবশ্য করোনাকালে প্রবাসী আয়ের এমন বিস্ময়কর ঊর্ধ্বগতিকে একেবারে উড়িয়েও দেন নি। সরকারি তথ্য নিয়ে কিছুটা সন্দেহগ্রস্থতা যে কোন গণতান্ত্রিক সমাজে এমনিতেই থাকে। একজন গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের জন্য ব্যাপারটি আরো স্বাভাবিক।
 
অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী-র সাক্ষাৎকারে কোন “সরকার বা রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্র” আছে এমনটি সম্ভবত খোদ সরকারও বলবেন না। উনি একটি মত প্রকাশ করেছেন। মতটি সঠিক বলে বিবেচিত না হলে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দিতে পারেন। প্রবাসী আয় বা অর্থনীতি দেখাশুনা করেন এমন রাজনৈতিক দ্বায়িত্বশীলদের কেউ একজন আরেকটি সাক্ষাৎকার, প্রতিবাদলিপি বা মন্তব্য প্রতিবেদন পাঠিয়েও ব্যাপারটি শেষ করতে পারেন। এসব কিছু না করে অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকীকে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি কর্তৃক রীতিমত “ব্যাখ্যা” দিতে “তলব” করা এবং “দুঃখ প্রকাশ করা”নোর মত অবস্থা তৈরি করাটা উদ্বেগজনক।


গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গবেষণা ও ভিন্ন মতের জবাব অধিকতর গবেষণা এবং আরেকটি ভিন্নমত দিয়েই দিতে হয়। চাপ সৃষ্টি করে বা জোর জবরদস্তি করে নয়। অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকীর ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা, চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সুস্পষ্টভাবে নিরুৎসাহিত করবে। সংসদীয় কমিটি-র এ পদক্ষেপ একজন সংসদ গবেষক হিসেবে আমার জন্য ব্যক্তিগতভাবেও পীড়াদায়ক।

জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ২০২(১) বিধিতে সংসদীয় কমিটিগুলোকে যে কোন ব্যক্তি, বিশেষজ্ঞ, তথ্য বা দলিল চেয়ে নোটিশ বা সমন জারি করার এখতিয়ার দেয়া আছে। ২৪৮ বিধিতে মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গুলোকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা এ সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে অনুসন্ধান করার এখতিয়ার দেয়া আছে। সাধারণভাবে সংসদীয় কমিটির আমন্ত্রণে সাড়া দেয়া নাগরিকের কর্তব্য। রাষ্ট্রের প্রতিনিধত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে শাসনযন্ত্রের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার গুরু দ্বায়িত্ব সংসদের এবং সংসদীয় কমিটিগুলোর। এক্ষেত্রে সরকারি আমলাদের বা পদধারীদের প্রয়োজনে তলব করে হাজির করানোর ক্ষমতা সংসদের আছে বলেই ধরে নিতে হবে।

তবে কার্যপ্রণালী বিধির ২০৩ বিধি অনুসারে কোন সমন বা তলবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সেটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার মাননীয় স্পীকারের। ২০৩ বিধিতে বলা হয়েছে এ ধরনের প্রশ্ন স্পীকারের কাছে পাঠানো হবে। ধারণা করা যেতে পারে কাজটি কমিটির সভাপতি বা সদস্য, অথবা সরকারের কোন মন্ত্রণালয় বা কর্মকর্তাকে ডাকা হলে তাঁরা কেউ করবেন। সাধারণ নাগরিকদের কাউকে ডাকা হলে তাঁর পক্ষ থেকে স্পীকারের কাছে আপত্তি জানানোর সুযোগ নেই বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ মাননীয় স্পীকার বিচারিক আদালত নন। সাংবিধানিক সার্বভৌমত্বে জনগণের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত। সংবিধান অনুসারে কাউকে জোর করে বা চাপ দিয়ে জবানবন্দী নেয়ার বা বক্তব্য আদায় করানোর সুযোগ নেই। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রতিষ্ঠিত জুরিস্প্রুডেন্স বলছে, সংসদীয় কমিটি বা এমনকি জাতীয় সংসদ নিজেও সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার বাইরে নন।

বাংলাদেশের মত যুক্তরাষ্ট্রও একটি সাংবিধানিক সার্বভৌমত্বের দেশ। মার্কিন কংগ্রেসের বিভিন্ন কমিটিগুলো অহরহ বিভিন্ন অনুসন্ধান, তদন্ত করেন। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার বিশেষজ্ঞ, সাক্ষী বা এমন কি কোন কোন অভিযুক্তকেও কমিটির সামনে আসতে সমন দেয়া হয়। মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট কাউকে সমন জারী করে কমিটির সামনে হাজির করানো অথবা কেউ সমন অবজ্ঞা করলে তাঁর ব্যাপারে সংসদ অবমাননার অভিযোগে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতাকে কংগ্রেসের অন্তর্নিহিত এখতিয়ার বলে স্বীকার করেন। তবে ১৯৫৭ সালের ওয়াটকিনস বনাম যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৬১ সালের উইলকিনসন বনাম যুক্তরাষ্ট্র, এবং ১৯৭৫ সালের ইস্টল্যান্ড বনাম যুক্তরাষ্ট্র মামলায় মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট এটিও প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন যে কংগ্রেসের সমন জারি করার এখতিয়ার নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারের বাইরে নয়। কংগ্রেসের সমনটি অবশ্যই এর এসেন্সিয়াল লেজিসলেটিভ বিজনেস এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

শুধুমাত্র কংগ্রেসের সমালোচনা বা কংগ্রেসের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের জন্য রাজনৈতিক ভাবে অস্বস্থিকর কোন কাজ, তথ্য প্রকাশ বা বক্তব্যের জন্য কোন সাধারণ নাগরিককে তলব করে কৈফিয়ত দাবী করার এখতিয়ার কংগ্রেসের বা কংগ্রেসীয় কমিটির নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, মার্কিন কংগ্রেস গত কয়েক দশকের ইতিহাসে কোন সমন অমান্যকারীকে সংসদ অবমাননার‍ অভিযোগে অভিযুক্ত করে শাস্তি দেয়ার চেষ্টাও করেন নি।

পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো সংসদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টও একই চেতনা ধারণ করেন। মার্কিন কংগ্রেস বা আমাদের জাতীয় সংসদের তুলনায় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট অধিকতর শক্তিশালী। ওখানে সংবিধান নয়, সংসদীয় সার্বভৌমত্ব চলে। তারপরও ইতিহাস বলছে, হাউস অব কমন্স সর্বশেষ কাউকে সংসদ অবমাননার অভিযোগে শাস্তি দিয়েছেন সেই ১৬৬৬ সালে। ২০১৩ সালে হাউস অব কমন্স ও হাউস অব লর্ডস এর যৌথ উদ্যোগে গঠিত একটি সংসদীয় কমিটি (Joint Committee on Parliamentary Privilege) সংসদ অবমাননাকে ফৌজদারি প্রক্রিয়ায় মোকাবেলা করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকার কথা বলেন।

আসল কথা হল, সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে কোন নাগরিককে তলব করার এবং কৈফিয়ত চাওয়ার ক্ষমতা অস্বীকার করা না হলেও, এ ক্ষমতার সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা স্বীকৃত। এ ধরনের তলব করা ও কৈফিয়ত চাওয়ার সাথে নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা (সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ), জোর পূর্বক বক্তব্য বা স্বীকৃতি আদায় হতে রক্ষা পাওয়ার স্বাধীনতা (সংবিধানের ৩৫(৪) অনুচ্ছেদ), বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্বশাসন, গবেষণা, চিন্তা ও মত প্রকাশের একাডেমিক স্বাধীনতা, এবং ক্ষেত্রবিশেষে সাংবিধানিক আদালতের এখতিয়ারের প্রশ্ন গভীরভাবে জড়িত। তাছাড়া কোন সরকারি তথ্য ও পরিসংখ্যান নিয়ে কোন নাগরিকের দ্বিমত থাকলে তাঁর কৈফিয়ত তলব করা সংসদীয় কমিটির কাজ কিনা অথবা সেটি সংসদের এসেন্সিয়াল লেজিসলেটিভ বিজনেস কিনা সে প্রশ্নও ব্যাপকভাবে আসতে পারে।

আলোচ্য সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী সংসদ অবমাননা করেছেন বলে কোন অভিযোগ নেই। গণতন্ত্রে সংসদ নামের প্রতিষ্ঠানটিই যেখানে মত, দ্বিমত ও ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ অবারিত রাখার জন্য প্রতিষ্ঠিত, সেখানে এ ধরনের “তলব” খুব উদ্বেগজনক। এটি উদ্বেগজনক কারণ, রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় সংক্রান্ত ইস্যুতে অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকীর মন্তব্যে নির্বাহী বিভাগ বা মন্ত্রণালয় ক্ষুদ্ধ হতে পারেন। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যদি অধ্যাপক সিদ্দিকীর উপর কোন চাপ সৃষ্টি করতে চান, তাহলে ওই মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির দ্বায়িত্ব হবে তাঁকে বরং সুরক্ষা দেয়া। সংবিধানে সংসদ আছে নির্বাহী বিভাগের সমালোচনাকে উৎসাহিত করে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে। সংসদীয় কমিটিগুলোর দ্বায়িত্ব হচ্ছে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, নির্বাহী বিভাগের সমালোচকদের চাপে রাখা নয়।

এম জসিম আলী চৌধুরী
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও
যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ লন্ডন এর সংসদ বিষয়ক পিএইচডি গবেষক।

No comments:

Post a Comment

In defence of the original constitution

[In October and November 2024 , Sifat Tasneem and I wrote a three-part series on Lawyer'sClub[dot]com calling the attempt to abrogate th...