Monday, September 2, 2024



সংশোধন, সংস্কার বা "নতুন সংবিধান" এর "একিলিস হিল"

ড এম জসিম আলী চৌধুরী
প্রভাষক, আইন, ইউনিভার্সিটি অব হল, যুক্তরাজ্য



আমাদের নতুন শাসকরা "রাষ্ট্র সংস্কার"র এক সুদূর প্রসারী কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছেন। তাঁদের মৌলিক এজেন্ডায় সন্দেহাতীতভাবে সংবিধান থাকবে। তাঁরা এটা নিয়ে কতদূর যাবেন সেটিই সম্ভবত এখন হিসেব নিকেশ হচ্ছে। এ ধরণের উচ্চভিলাষী কর্মযজ্ঞের একটা "একিলিস হিল" আছে।

আমাদের নব্বই পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যক্তি বদল করে এবং নির্বাচনী কিছু আইন সংশোধন করে তাঁদের সংস্কার কর্মসূচী শেষ করতেন। তারপর একটা নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিতেন। তাদের তুলনায় ২০০৭-০৮ এর "তত্ত্বাবধায়ক সরকার" (আমি অবশ্য এটাকে সংবিধান বহির্ভুত সেনা সমর্থিত সরকার বলতে স্বচ্ছন্দ) বেশ আগ্রাসী ছিলেন। "দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা" ও "মাইনাস টু" রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জিগির তুলে তারা দেশের আইন কানুনেও বেশ অনেকটা সংশোধন করেছিলেন। মঈন উদ্দিন আহমেদ সাহেব রাখঢাক না রেখেই "মেধাবী ও তরুণ প্রজম্ম"কে দিয়ে একটা "জাতীয় সাংবিধানিক কনভেনশন" করে সংবিধান নতুন করে লেখার কথা বলেছিলেন। তিনি স্পস্টভাবেই জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সাহেবের মতো করে রাজনৈতিক দল গঠনের কাজকর্ম শুরু করেছিলেন। হালে পানি পাওয়ার আশায় ভারত সফরেও গিয়েছিলেন। আমেরিকা ও ইইউ ব্লকের যারা ১/১১-র স্পন্সর ছিলেন তাদের পূর্ণ সমর্থন পান নি বলে হয়তো শেষমেশ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

সন্দেহ নেই আমাদের বর্তমান সরকারটি ১৯৯০ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর মত নয়। ১/১১ এর মতো সংবিধান বহির্ভুত হলেও, এটি ওই সেনা সমর্থিত সরকারের চেয়ে অনেক বেশী জনগণ সংশ্লিষ্ট এবং এই সরকারের ম্যান্ডেট অনেক বেশি শক্তিশালী। তারপরও এর "সংস্কার এজেন্ডা"র সবচেয়ে বড় সংকটটি - যেটিকে আমি এর "একিলিস হিল" বলতে চাই - সেটি তুলে ধরা বাঞ্চনীয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিপদজনক প্রশ্ন হচ্ছে - কাদের ইচ্ছায়, কাদের আদর্শিক অবস্থানকে প্রায়োরিটি দিয়ে সংস্কার হবে। সংস্কারের এজেন্ডা কি হবে, কোথায় সংস্কার হবে এবং কারা এই সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশীজন হবেন। বিশেষত সমাজের সব মত-পথের মানুষকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংষ্কার না হলে দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো সংস্কারও মুখ থুবড়ে পরে। সমস্যা হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়াটা সবসময় সহজ কাজ নয়। যেমন ধরুন এখনকার বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের অংশ নেয়া তো দূরের কথা, ছায়া মাড়ানোর কথা বলাও বিপদজনক। "জনগণ" "পরাজিত"দের মুখ দেখতেই চায় না। যে কোন রাজনৈতিক বিপ্লবের পর যারা হেরে গেছেন তাদের সাথে কথা বলার চিন্তা করাও অকল্পনীয়। এটি জনতুষ্টিবাদী গণতন্ত্র (Populist Democracy)-র একটি "একিলিস হিল"।

এটি "একিলিস হিল" কারণ এ আপদ চাইলেই মুছে ফেলা যায় না। একে মেনে নিয়েই কাজ সারতে হয়। একে ইগনোর করে বিজয়ীরা হয়ত তাৎক্ষণিক জেতেন। তবে দূরের কোন একদিন আবার ওই আপদ মাথা ছাড়া দিয়ে উঠে। "জনগণ"ও ততোদিনে "জয়ী"দের থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকাতে শুরু করে। পেছন দিকে তাকানোর কথাটা এই মুহূর্তে আমাদের অনেকেরই বিশ্বাস হবে না। তারপরও মনে করা যেতে পারে ১৯৭২ সালের জানুয়ারীর কথা।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেন। অন্তর্বর্তী সংবিধান দিলেন। সে অনুযায়ী ১৯৭২ এর ডিসেম্বরে একটা সংবিধান হলো। সংবিধান প্রণয়ন, এর উপর জন মত যাচাই, সংশোধন প্রস্তাব আহবান ও বিবেচনা, দেশী বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ-সালাপ সবই হলো। সংবিধান প্রণীত হয়ে যাওয়ায় পর রাশিয়া ও চীন ঘেঁষা বাম রাজনৈতিক দল এবং আমেরিকা ঘেঁষা প্ৰধান বিরোধী দল (জাসদ) সহ সর্বস্তরের বিরোধী দলের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া এলো। মস্কো পন্থী বাম-রা সমর্থন দিলেন। চীনপন্থী বাম-রা ১৯৭০ এর নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগ নেতাদের স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণনয়নের অধিকার বা ম্যান্ডেট আছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন। বললেন, ১৯৭০ এর বিজয় এক জিনিস আর ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়ণ আরেক জিনিস (তেমন প্রশ্ন এখন যারা ছাত্র আন্দোলনের ফলে ক্ষমতায় এসেছেন তাঁরাও ফেস করতে পারেন)। জাসদের পক্ষ থেকে সংবিধানটিকে "বৈজ্ঞানিকভাবে সমাজতান্ত্রিক নয়" বলে সমালোচনা করা হলো এবং বলা হলো, তাঁরা ক্ষমতায় আসলে এটি ছুঁড়ে ফেলে দেবেন।

এবার দেখুন ১৯৭২ এর সংবিধানের "একিলিস হিল"টা কোথায়। পুরো সংবিধান প্রনণয় ও এর সমালোচনা পক্রিয়ায় মুসলিম লীগ (১৯৭১ এর আগে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্ধী), জামায়াত ইসলামী, নেজামে ইসলামীসহ ইসলামপন্থী দলগুলোর যে বিশাল সামাজিক অবস্থান ও সমর্থক গোষ্টি দেশে রয়ে গেছে তাদের কোন পালস, অনুভূতি, বক্তব্য বা প্রতিক্রিয়া শোনার, জানার বা চিন্তায় নেয়ার গরজ কারো পড়ে নি। কারণ তারা তখন বিপ্লবের "পরাজিত পক্ষ"। আজকের মতো সেদিনও "জনগণ" ও তাঁদের নেতারা "পরাজিত"দের মুখ দেখা তো দূরের কথা, ছায়া মাড়াতেও রাজী ছিলেন না। বাস্তবতা হচ্ছে, আপনি কাউকে না দেখলেই তারা অস্তিত্বহীন হয়ে যায় না। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ এ জাসদ না, ইসলাম পন্থী দলগুলোর সমর্থনপুষ্ঠ গোষ্ঠীরাই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন এবং ১৯৭২ এর সংবিধানের খোল নলচে পাল্টে দেন। আমাদের মতো ডিভাইডেড সোসাইটিতে এটিই যে কোন বিপ্লবের, সংস্কারের বা সংবিধানের "একিলিস হিল"। দুই বছর আগে, ২০২২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবস উপলক্ষে ইংরেজি দৈনিক "দ্য ডেইলি স্টার" এ আমি লিখেছিলাম (লিংক প্রথম কমেন্টে) -

"[T}he total exclusion of the religious-conservative political elements from the constitution-making process (how logical it appeared in 1972) had reduced (if not dislodged) the Constitution's political morale. In 1972, an essential requirement of the parliamentary system – conservative-liberal bipartisanship, was conspicuously missing. The conservative political elements of undivided Pakistan - the Muslim League (ML) and Jamaat-e-Islami (JI), actively opposed the liberation of Bangladesh. They lost their right to exist in the newly independent country, but the pro-Soviet leftists could not fill the vacuum with their insignificant mass base in society. So, the seismic political change of 1975 led to a quick resurgence of the radical right. From that point onwards, Bangladesh's constitutional unmaking has been rapid. Avenging their exclusion from the constitution-making process, the religious nationalists would actively deconstruct the Constitution and its foundational pillars."



[শেষ কথা: অনেকেই হয়তো ভাবছেন আমি ইনিয়ে বিনিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে সংলাপ করতে বলছি। না। আমার ঘাড়ে দুইটা মাথা নেই।আওয়ামী লীগ নিজেই এখন কোথাও বসার মতো অবস্থায় নেই (যেমনটি ১৯৭২ এ মুসলিম লীগ, জামায়াত ইসলামী ছিলো না)। আমি বলছি বর্তমান সংস্কার প্রক্রিয়াটিকে যতদূর সম্ভব রাজনৈতিক রাখার কথা। সংবিধান সংশোধন বা নতুন সংবিধান প্রনণয়নের কাজটি নির্বাচনের পর জয়ী সরকারী ও বিরোধী দলের হাতে ছেড়ে দিলেই হয়তো তারা বর্তমানের "বিপ্লবী উত্তেজনার" ক্ষণটা পেছনে ফেলে ঠান্ডা মাথায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দিকে যেতে পারবেন। আগামীর সরকারি দল ছাত্রদের নব গঠিত কোন রাজনৈতিক দল, বিএনপি বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল যে-ই হোক, তাঁরা যে পুরো অন্তর্ভুক্তিমূলক হবেন সেটা নিশ্চিত নই (যেমন ২০১১ সালে ১৫-তম সংশোধনীর সময় সে রকম একটা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা গোঁয়ার্তুমি করেছেন)। তবে তাঁদের একিলিস হিল-টা হয়ত বর্তমানের অরাজনৈতিক সরকারের চেয়ে কম হবে। বিপ্লব ভালো। তবে প্রতিটি বিপ্লবের উত্তেজনার ভেতরেই এর ধ্বংসের বীজ লুকিয়ে থাকে।]

ডেইলি স্টারের লেখাটির লিংক: Constitution-making and unmaking in Bangladesh | The Daily Star

No comments:

Post a Comment

‘বদলে না যাওয়া’ বাংলাদেশ ড. এম জসিম আলী চৌধুরী প্রভাষক, ইউনিভার্সিটি অব হাল, যুক্তরাজ্য লেখাঃ ১৩ জুন ২০২৪ প্রকাশঃ দৈনিক আজকের পত্রিকা (৩ সেপ...