Monday, September 2, 2024



সংস্কার লগ্ন (Reform Window)
ড এম জসিম আলী চৌধুরী
প্রভাষক, আইন, ইউনিভার্সিটি অব হল, যুক্তরাজ্য

২৪ অগাস্ট ২০২৪ (ফেসবুক পোষ্ট)



বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক সাহেব একজন দাম্ভিক মানুষ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। সেটা শুধু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নয়। চার দলীয় জোট সরকারের ২০০১-২০০৬ মেয়াদেও সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে তিনি ট্রাফিক পুলিশের সালাম দেয়া না দেয়া সহ নানাবিধ ছোটখাট ব্যাপারে অতিরিক্ত একগুঁয়েমি দেখানো, অ-বিচারক সুলভ ও অশোভন আচার-আচরণ করেছেন। উনার আচরণ, কথাবার্তা এবং চলন-বলনের ভেতর প্রজ্ঞা, ধৈর্য, ভিন্নমত ধারণকারীকে প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়ার প্রবণতা বা এমনকি সমালোচকেরও শ্রদ্ধা অর্জনের মতো কোন কিছু চোখে পড়তো না। নিজের পেশাগত ও সামাজিক অবস্থানের তোয়াক্কা না করে তিনি আচরণ করতেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর একেবারে মাঠ পর্যায়ের গুন্ডাপান্ডা টাইপের লোকদের মতো করে।

সংবিধান নিয়ে পড়ালেখা করতে গিয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের দেয়া বিভিন্ন রায়গুলোতেও জুরিসপ্রুডেন্সিয়াল কোন ডেপথ আমি কখনো পাই নি (সেটি এমনিতেও আমাদের খুব বেশি রায়ে পাওয়া যায় না)। উনাকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে কোথাও রেফারও করি না।

তারপরও দুঃখ লাগছে, গ্রেফতার হওয়ার সময় হতে উনার সাথে আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আচরণ সহ আদালত প্রাঙ্গণে উনার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দেখে। গতকাল গ্রেফতার হওয়ার পর, উনার দুর্দশা ও লাঞ্ছনাকে অনেকেই "ন্যাচারাল জাস্টিস" বলছেন। হয়তো হতেও পারে। আল্লাহ্‌র বিচার নিয়ে আমি বান্দার বুঝ ব্যবস্থা সীমিত। এই "ন্যাচারাল জাস্টিস" থেকে কোন শিক্ষা হয়তো ক্ষমতার বলয়ে আসা-যাওয়া করতে থাকা মানুষরা কেউ নিতে পারেন (যদিও এমন শিক্ষা আমি আজ পর্যন্ত কাউকে নিতে দেখি নি)।


দুনিয়ার আদালতে আমরা যদি উনার সাথে উনার মতোই আচরণ করি, তাহলে উনার সাথে আমাদের পার্থক্য কি হল? উনাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়েছে বলে ধরে নিচ্ছি, আচরণগত ও রাজনৈতিক মতাদর্শ জনিত নিন্দাবাদ ছাড়া, উনার বিরুদ্ধে ঠিক কি ধরনের ফৌজদারি বা দেওয়ানি অভিযোগ আনা হবে সেটি এখনো চূড়ান্ত হয় নি। রাষ্ট্রের কাছে একজন দাগী অপরাধীরও নুন্যতম প্রাপ্য কিছু থাকে। অতীতের কর্দমাক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ভেঙ্গে চুরে প্রত্যাশিত বা প্রতিশ্রুত নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি আসলেই আমরা গড়তে চাই তাহলে এই 'আপাতত আগেরগুলোর শোধ তুলে নিই, সংস্কার পরে দেখা যাবে" মানসিকতাটা কোন শুভ সংকেত দেয় না।

হয়ত কেউ কেউ ভাবতে পারেন, রাজনৈতিক ভাবাদর্শে আমি আওয়ামী লীগ ঘরানার লোক বলে শুধুমাত্র শামসুদ্দিন মানিক সাহেবেরটা বেশি করে দেখছি। ব্যাপারটা আসলেই তেমনটি না। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নিয়ে আমার প্রকাশিতব্য বইটিতে আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি কিভাবে, কেন এবং কোন মানসিক ও সামাজিক ব্যধির চক্রে পড়ে আমাদের ৫৩ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে আসা পাঁচ-পাঁচটি সংস্কার লগ্ন (Reform Window) ব্যর্থ হয়ে গেছে এবং আমরা ঘুরে ফিরে সেই আগের পাক-চক্রে পড়ে থেকেছি। আমার বইয়ে আলোচিত পাঁচটি সংস্কার লগ্ন হচ্ছে - ১৯৭২ এ স্বাধীন দেশের যাত্রা শুরুর মুহূর্ত, ১৯৭৫ এর মধ্য অগাস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরের মুহূর্ত, ১৯৯০ এর গণ অভ্যুত্থান এর পর গণতন্ত্রের পথে নবযাত্রার মুহূর্ত, ২০০৭ এর ১/১১র পর মাইনাস টু ফর্মুলায় দুর্নীতিমুক্ত নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির আশা দেয়ার মুহূর্ত, এবং ২০০৯ এ ভুমিধ্বস বিজয় নিয়ে আওয়ামী লীগের নতুন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের মুহূর্ত।

দুঃখজনকভাবে প্রতিটি বাঁক বদলের মুহূর্তই চরম ব্যর্থতায় কালের গর্ভে হারিয়েছে। আশা করি ও দোয়া করি - এই ষষ্ট মুহূর্তটিও কালের গর্ভে না হারাক।

No comments:

Post a Comment

‘বদলে না যাওয়া’ বাংলাদেশ ড. এম জসিম আলী চৌধুরী প্রভাষক, ইউনিভার্সিটি অব হাল, যুক্তরাজ্য লেখাঃ ১৩ জুন ২০২৪ প্রকাশঃ দৈনিক আজকের পত্রিকা (৩ সেপ...