Thursday, October 17, 2024




ড. এম জসিম আলী চৌধুরী
প্রকাশ :দৈনিক আজকের পত্রিকা, ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৪৫


‘সংস্কার’ আমাদের এক পৌনঃপুনিক নিয়তি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতারা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ২৪ বছরের স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতিতন্ত্র থেকে চিরস্থায়ী মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক ভিত্তিগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে তাঁরা সংসদীয় গণতন্ত্রব্যবস্থা বেছে নেন। কিন্তু এ সুখ আমাদের বেশি দিন সয়নি। ১৯৭৫ সালে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর ডাক দিয়ে একটি জাতীয় দলভিত্তিক রাষ্ট্রপতির শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়। এটিও টেকেনি। কয়েক মাসের মধ্যেই দেশ রক্তপাত এবং চরম বিশৃঙ্খলার ভেতর পড়ে যায়। ১৯৭৫-৭৯ সময়কালটা পুরোটাই সংবিধান সংস্কার, সংশোধন এবং পুনর্লিখনে কেটেছে। এ সময় সংবিধানের মূলনীতিগুলোকে পরিবর্তন করা হয়। বহুদলীয় রাজনীতি ফিরিয়ে আনা হলেও রাষ্ট্রপতিব্যবস্থা রেখে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থাকে বরং আরও সংহত করা হয়। ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে আবার রক্তপাত এবং আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান। এবার এক সামরিক শাসক সংবিধান স্থগিত করেন, নিজে একটি অন্তর্বর্তী সংবিধান দেন এবং সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলোকে আরও পরিবর্তন করেন। ১৯৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত সময়ে দেশে বড় দুটি রাজনৈতিক দল জন্ম নেয়। জামায়াতে ইসলামী পুনঃস্থাপিত হয়। আওয়ামী লীগও বাকশাল ছেড়ে নিজের জায়গায় ফিরে আসে। সামরিক সরকারগুলো প্রথম দিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। তারপর আস্তে আস্তে রাষ্ট্রপতি স্বৈরাচার, দুর্নীতি, ভোট কারচুপি ও রাজনীতির দূষণে মেতে ওঠে। সংসদ, স্থানীয় সরকার, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারপ্রধানের এবং সরকারি দলের খামখেয়ালির কাছে জিম্মি থেকে যায়। ১৯৯০ সালের শেষের দিকে স্বাধীন দেশের প্রথম গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। সামরিক শাসন বিদায় নেয় এবং বেসামরিক শাসনের সূচনা হয়।



















১৯৯১ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের একটি প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিষ্ঠান জন্ম নেয় এবং সংসদীয় ব্যবস্থা ফিরে আসে। তবে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণের মধুচন্দ্রিমাও বেশি দিন টেকে না। দ্বিদলীয় ব্যবস্থাটা প্রতিযোগিতামূলকভাবে কর্তৃত্ববাদী, সংঘাতপূর্ণ, ষড়যন্ত্র এবং কূটচালের রাজনীতি হয়ে ওঠে। নিয়মিত ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর কেন জানি অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৬ সালে আবার জ্বালাও-পোড়াও ও গণ-আন্দোলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসে। গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার রদবদল টিকিয়ে রাখার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনেকটা নিশ্বাস ফেলার জায়গা হয়ে দাঁড়ায়। সংসদীয় ব্যবস্থা অবশ্য জবাবদিহিহীনতা, দুর্নীতি এবং রাজনীতির পারিবারিকীকরণ, দুর্বৃত্তায়ন এবং গোষ্ঠীস্বার্থের আখড়ায় পরিণত হয়। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আর কোথাও সামগ্রিকভাবে জবাবদিহিমূলক শাসন ও ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। স্থানীয় সরকার, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, আমলাতন্ত্র এবং সংসদ—সবই দলীয় সরকার এবং সরকারপ্রধানের অদম্য ক্ষমতালিপ্সার কাছে আত্মসমর্পণ করে। ২০০৬ সাল আসতে আসতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটিও নষ্ট করে দেওয়া হয়।


২০০৭ সালে সামরিক বাহিনী আবার দৃশ্যপটে আসে। তারা রাষ্ট্রের সমস্যাগুলো একবারে এবং চিরতরে সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেয়। আবারও ‘দুর্নীতিবিরোধী অভিযান’ শুরু হয়। এবার বড় দুটি রাজনৈতিক দলের ‘সংস্কার’ কাজে হাত দেওয়া হয়। বহুল প্রচারিত ‘মাইনাস-টু’ ফর্মুলার মাধ্যমে দলের নেতৃত্ব পরিবর্তনের চেষ্টা চলে। তবে একই সঙ্গে সেনাপ্রধানের নিজের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ প্রকাশ হতে থাকায় ফর্মুলাটি দ্রুতই আকর্ষণ হারায়। সংস্কারের প্রাথমিক উদ্যম দেড় বছরের মধ্যে ম্লান হয়ে আসে। ২০০৮- এর শেষের দিকে সামরিক নেতৃত্বকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হলেও তাঁরা নিম্ন আদালতকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করে যান এবং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও কাঠামোয় উল্লেখযোগ্য সংস্কার আনেন। দুর্নীতি দমন কমিশন এবং অন্যান্য জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও উল্লেখযোগ্য সংস্কার করা হয়। ২০০৯ সালের শুরুতে ‘দিনবদলের সনদ’ নামে ব্যাপক জনপ্রিয় একটি রাজনৈতিক মেনিফেস্টো দিয়ে একটি বড় দল ক্ষমতায় আসে। কিন্তু দিন বদল হওয়ার বদলে খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে। পরবর্তী ১৬ বছর বাংলাদেশ তার ইতিহাসের দীর্ঘতম একদলীয় আধিপত্য এবং কর্তৃত্ববাদী প্রধানমন্ত্রীর শাসনের ভেতর দিয়ে যায়।


২০২৪ সালে আরেক দফা রক্তপাত, যন্ত্রণাদায়ক সহিংসতা এবং ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনে ওই সরকারের পতন হয়েছে। এখন একটি ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ ক্ষমতায় এসে সংবিধানসহ রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে আবার সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে। সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো স্বাধীনতার পর থেকে যেগুলো আমরা বারবার দেখে আসছি সেগুলোই—প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, জবাবদিহি, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দুর্নীতিমুক্ত শাসন।


এখন অনেকেই সমস্যাগুলোর জন্য সংবিধানের মূলনীতিকে দায়ী করছেন। তাঁরা ওগুলো নতুন করে লিখতে চান। অথচ মূলনীতিগুলো আমরা অতীতে অন্তত চারবার পাল্টেছি, ভেঙেছি ও গড়েছি (১৯৭৫, ১৯৭৯, ১৯৮৮ এবং ২০১১)। অন্য অনেকে বলছেন, সাংবিধানের মূলনীতি না বরং কাঠামোটাই ত্রুটিপূর্ণ। তাঁরাও কাঠামোটিকে নতুন করে সাজাতে চান। অথচ কাঠামোটাও আমরা অতীতে অন্তত পাঁচবার উল্টেপাল্টে দেখেছি (১৯৭৫, ১৯৭৯, ১৯৯২, ১৯৯৬ এবং ২০১১)। এতবার সংস্কারের এতবার ব্যর্থতার জন্য একাডেমিক গবেষকেরা পাইকারিভাবে ‘রাজনৈতিক ইচ্ছা’ এবং রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ‘প্রাতিষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব’কে দায়ী করেন। অথচ রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার নিয়ে সরাসরি কিছু বলেন না। এবারো বলছেন না।


বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে ২০২৪-এর আগপর্যন্ত আমরা অন্তত তিনটি নতুন করে শুরু করার মুহূর্ত পেয়েছি—১৯৭২, ১৯৯১ এবং ২০০৯। প্রতিটি মুহূর্তে রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতারা সময়ের সম্ভাব্য সেরা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য পেয়েছিলেন। অথচ প্রতিটি মুহূর্তই শোচনীয় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ক্ষমতা পাওয়া রাজনৈতিক দলগুলো যেটুকু ভালো পেয়েছিল তার সবটুকু নষ্ট করে দিয়ে তাদের নিজেদের ক্ষমতাকে সুসংহত ও স্থায়ী করায় মনোযোগ দিয়েছে। ২০২৪ সালে এসেও তারা এখানে-ওখানে এই সংস্কার, ওই সংস্কার, ৩১ দফা, ১০ দফা ইত্যাদি প্রস্তাব-প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। প্রশ্ন হলো, আমরা কি তাদের আর আদৌ বিশ্বাস করতে পারি?


সংবিধানে যে প্রাতিষ্ঠানিক এবং আইনি কাঠামো দেওয়া হয়, সেগুলো দেওয়া হয় রাষ্ট্র যেন একটি স্বশাসিত ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে সে উদ্দেশ্যে। সংবিধান নিজে এগুলো বাস্তবায়ন করবে না। রাজনৈতিক দলগুলোই এগুলো বাস্তবায়ন (বা ধ্বংস) করবে। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা সব সময়ই সংবিধানের সীমা ও নিয়মের বাইরে থেকে গেছে।



প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রিচার্ড পিল্ডাস দেখিয়েছেন যে সংবিধান কয়েকটি উপায়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে জবাবদিহি করাতে পারে। সংবিধান গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় সব দলের সমান অংশগ্রহণ এবং সবার জন্য সমর্থন অনুপাতে রাষ্ট্রীয় তহবিল বরাদ্দ দিয়ে তাদের আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। সংসদের মতো প্রতিষ্ঠানে রাজনীতিতে স্থায়ী সংখ্যালঘুদের জন্য আসন সংরক্ষণ করার মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্থায়ী কর্তৃত্বের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে পারে। নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলোকে অসাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। সবশেষে, এটা নিশ্চিত করতে পারে যে দলগুলো নিজেরা অভ্যন্তরীণভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জনগণের ভেতর থেকে নেতৃত্ব উঠে আসার পথ খোলা রাখবে।


২০২৪-এর সংস্কার প্রকল্পের একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ হতে হবে, রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারকে নষ্ট করার কাজটি যেন আর করতে না পারে। এবারের সংস্কার অ্যাজেন্ডায় রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার এবং তাদের সংবিধানের কাঠামোর ভেতরে নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। জনগণকে জানতে হবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে গঠিত হয়, কীভাবে চলে, অর্থ কোত্থেকে পায়, খরচ কোথায় করে, তাদের নেতা কীভাবে নির্বাচিত হয় এবং জনগণের বা রাষ্ট্রের কাছে তাদের জবাবদিহি কোথায়। এবারের সংস্কারকে সফল হতে এবং দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে উপেক্ষিত এ প্রশ্নগুলোর সমাধান হতে হবে।


লেখক: প্রভাষক, আইন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব হাল, যুক্তরাজ্য



No comments:

Post a Comment

সংস্কারপ্রক্রিয়া ও কিছু উপেক্ষিত প্রশ্ন ড. এম জসিম আলী চৌধুরী প্রকাশ :দৈনিক আজকের পত্রিকা,  ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৪৫ https://www.ajkerpatrika....