Sunday, December 9, 2012

Caretaker Government No Alternatives?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার : বিকল্প নেই?

এম. জসিম আলী চৌধুরী

দৈনিক পূর্বকোন - বুধবার, ২৫ জুলাই ২০১২

লিংক : http://www.dainikpurbokone.net/index.php?option=com_content&view=article&id=41471:2012-07-24-18-25-07&catid=9:2011-05-26-03-33-23&Itemid=5

পরে প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সুপ্রভাত পত্রিকায় - বুধবার ৮ অগাস্ট ২০১২, ও শনিবার ১১ অগাস্ট ২০১২

লিংক http://www.esuprobhat.com/index.php?page=4&date=2012-08-08

http://www.esuprobhat.com/index.php?page=4&date=2012-08-11



১১ই ফেব্রুয়ারি শনিবার একটু দেরি করেই ঘুম ভাঙ্গল। অনাকাঙ্ক্ষিত, অগ্রহণযোগ্য এবং নিন্দনীয় সহিংসতায় আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এমনিতেই মন খারাপ। তার উপর যোগ হয়েছে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের Law and Our Rights (আইন-অধিকার) পাতায় আমার এক প্রিয় শিক্ষকের দুঃখজনকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট লেখা পড়ার যন্ত্রণা। অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের একজন স্বনামধন্য শিক্ষক, আইন অনুষদের প্রাক্তন ডীন এবং বাংলাদেশে উচ্চতর মানবাধিকার গবেষণার একজন পথিকৃৎ। স্যারের সরাসরি ছাত্র না হলেও তার লেখার আমি মনোযোগী পাঠক। আমি স্যারের কাছে শিখতে ভালবাসি এবং তাঁকে যুক্তির সঠিক প্রান্তে দেখতেই পছন্দ করি। ঐ দিনের ডেইলি স্টারে প্রকাশিত স্যারের ÔNecessity of a Non-party Caretaker GovernmentÕ (নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা) শীর্ষক লেখাটিকে আমার একটু বেশি বৈষয়িক (ঝঁনলবপঃরাব), জটিল আইনী প্রশ্নের অতি সহজীকরণ দোষে দুষ্ট এবং অসঙ্গতিপূর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি (স্যারের কাছে শিক্ষাবিদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাশা করেছিলাম) দ্বারা প্রভাবিত বলেই মনে হয়েছে।



তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৩ যুক্তি
ড. বোরহান স্যার লেখা শুরু করেছেন এভাবে-‘‘একটি নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত প্রথাগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার (Conventional Caretaker Government) হিসেবে আগের সরকারের দায়িত্ব পালন করে যাওয়াটা পৃথিবীর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে নতুন কোন সংযোজন নয়। ব্রিটিশ সংসদীয় গণতন্ত্র পালনকারী দেশগুলোতে এটাই বরং স্বাভাবিক’’। কথাটার সহজ সরল অর্থ হচ্ছে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার পর বর্তমানে যে ব্যবস্থা আছে সেটিই সারা বিশ্বে স্বীকৃত। কিন্তু না। ড. বোরহান স্যার এ ধরনের প্রথাগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (Conventional Caretaker Government) প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন না। তিনি বরং ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে করা ‘‘অনন্য’’ (টহরয়ঁব) নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলছেন। দাবীর স্বপক্ষে যুক্তি সব মিলিয়ে তিনটি-
প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরাজমান ‘‘আস্থা ও বিশ্বাসের সংকটের’’ প্রেক্ষিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন বিকল্প নেই (no alternative)। হ্যাঁ, আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। তবে যতদিন না এটি আসছে ততদিন পর্যন্ত আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আমরা স্থগিত রাখতে পারি না (we cannot withhold our democratic process till we reach the longed political culture)। রাজনৈতিক সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে তার কোনোটিই জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল যার ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তৎকালীন জনদাবীর মুখে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার প্রতিনিধিত্বকারী (representing the people of vast multitude) ক্ষমতাসীন দল এটি স্বীকার করে নেয়। এটি বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছে। তৃতীয়ত, বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তের ক্রমধারা (১৯৯৬ এবং ২০০৪ সালে দেয়া হাইকোর্ট বিভাগের রায়) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈধতার পক্ষে। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হিসেবে একে বিচার বিভাগ স্বীকার করে নিয়েছে। এমন কি আপীল বিভাগে ইস্যুটির বিবেচনার সময় ৮ জন এমিকাস কিউরির মধ্যে ৭জনই এ ব্যবস্থা রাখার পক্ষে বলেছেন। কিন্তু আমাদের সবাইকে হতবাক করে দিয়ে (to our utter surprise) মহামান্য আপীল বিভাগ ব্যবস্থাটিকে অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক বলে রায় দেন। আবার আগামী ২টি নির্বাচন এ ব্যবস্থায় করা যেতে পারে বলে মত দেন। দুঃখজনকভাবে (ironically) রায়ের কারণ জানার আগেই সংসদ ব্যবস্থাটিকে বাতিল করে দেয়।


প্রথম যুক্তির বিপরীতে

প্রথম যুক্তির প্রথম দোহাই, ‘‘আস্থা ও বিশ্বাসের’’ সংকট প্রসঙ্গে বলি। একজন নির্মোহ শিক্ষাবিদের দৃষ্টিতে যদি বিষয়টা দেখতে চাই, তাহলে শুধুমাত্র আস্থা নেই বলে আমি পার পাব না। আস্থা কেন নেই এবং না থাকার পেছনে যৌক্তিক কি কি কারণ থাকতে পারে তার অনুসন্ধান চালানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমার মনে হয়েছে ড. বোরহান স্যার এ দায়িত্ব পালন করেন নি। আমরা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর অনাস্থার ইতিহাস দেখতে চাই।

১৯৭৩ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত ১ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের অনেক স্থানে অতি উৎসাহী কর্মীদের অতি তৎপরতা তৎকালীন বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু বিচ্ছিন্ন এসব তৎপরতা নির্বাচনের পুরো ফলাফল উল্টে দিয়েছে এমন দাবী কেউ কখনো করেন নি। বস্ত্তত আওয়ামী লীগের নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া অনুমিতই ছিল।

তারপর ১৯৭৭ সালে জিয়ার রেফারেনডাম দিয়ে শুরু। তিনি পেলেন মোট ভোটের ১০২ভাগ! ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচন, ১৯৮১ সালে জিয়ার পর সাত্তারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, ১৯৮৬ সালে এরশাদের সংসদ নির্বাচন, ১৯৮৮ সালের কুখ্যাত মিডিয়া ক্যু-র সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৪ সালের মাগুরা উপনির্বাচন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন, ২০০৪ সালে মেজর মান্নানের আসনে ফালুর নির্বাচন- তালিকার সবটুকু জুড়েই সেনাবাহিনী থেকে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর কৃতিত্ব। বিচারপতি রউফ, বিচারপতি সাদেক আর সবশেষে বিচারপতি আজিজের তেলেসমাতি নির্বাচন কমিশনের সাফল্য গাঁথা বর্তমানে যারা নির্বাচন কমিশনের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না তাদের গলায়ই মানায় সবচেয়ে বেশি।


১৯৭৩ এর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৬-২০০০ সময়কালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন কিংবা সংসদীয় উপ-নির্বাচনগুলোতে আবু হেনা অথবা এম এ সায়ীদের নির্বাচন কমিশনের উপর কার্যকর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার কোন সরাসরি অভিযোগ কেউ কখনো তুলেন নি। তবে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম আওয়ামী লীগ ত্যাগ করলে তার শূন্য আসনে উপ নির্বাচনটিকে আওয়ামী লীগ প্রেস্টিজ ইস্যু হিসেবে নেয়। সেখানে কিছুটা নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ আসে। ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় আসার পর এ টি এম শামসুল হুদার কমিশনের উপর প্রভাব বিস্তারের কোন সুযোগ আওয়ামী লীগ নেয় নি, পায়ও নি। চট্টগ্রাম, নারায়নগঞ্জ, কুমিল্লা সিটি নির্বাচন, সবগুলো সংসদীয় উপনির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, ইউ পি নির্বাচন কোনটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে নি কোন মহল থেকে। অবশ্য যাদের প্রশ্ন না তুললেই নয়, তারা তুলেছেন। দলীয়ভাবে অংশ নেন নি। দলের কেউ অংশ নিলে বহিষ্কার করেছেন। জিতলে আবার পুষ্পমাল্য গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ৪০ বছরের পুরনো আসন হবিগঞ্জ তারা হারিয়েছে। তবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন দিতে সরকারের অনীহা এবং নারায়নগঞ্জ নির্বাচনে সেনা মোতায়েনে রাজী না হওয়া নির্বাচন কমিশনকে বিরক্ত করেছে। মজার ব্যাপার হল সেনাবাহিনী থেকে জন্ম নেওয়া দলগুলোর আমলে নির্বাচন কমিশন এমন বিরক্ত হওয়ার দুঃসাহস দেখাতে পারত কিনা প্রশ্ন সাপেক্ষ। যা হোক, সরকারের এমন অসহযোগিতার দাওয়াই অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অন্য কিছুতে পাওয়া যায় কিনা তা আমি এই লেখার শেষের দিকে দেখাব। ড. বোরহান স্যারের কাছে আসি। দেখা যাচ্ছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার মূল দায় বর্তমান বিরোধী পক্ষের উপরই পড়ে বেশি। অথচ বোরহান স্যার অবলীলায় দায়টা সব দলের উপর সমান ভাগে ভাগ করে দিলেন! বললেন দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতেই পারে না! জনগণের আস্থাও নেই এতে। কই বিরোধী দলের বর্জনের মুখে (যদি আসলেই একে বর্জন বলেন) জনগণ ভোট দিতে যাচ্ছে না- এমন তো দেখছি না! তাহলে আমরা বিরোধী দলের রাজনৈতিক জোটের ‘‘অনাস্থা’’কে কি যৌক্তিক অনাস্থা বলতে পারছি? সুশীল সমাজ শুধুমাত্র সরকারের সমালোচনা করার জন্য নয়। আমার মনে হয় বেপথু বিরোধী দলকে পথে আনার গুরুদায়িত্বও সুশীল সমাজ পাশ কাটাতে পারে না। যেখানে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কাঠামোতে সামান্য পরিবর্তন আনলেই ‘‘সুষ্ঠু নির্বাচনের’’ সোনার হরিণ ধরতে পারি সেখানে গণতন্ত্র হরণকারী আর বিচার বিভাগ দূষণকারী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য এমন মামা বাড়ির আবদার কেন? ‘‘আস্থা ও বিশ্বাস’’ থাকুক এটা বোরহান স্যার চান। তবে না আসা পর্যন্ত ঐ তত্ত্বাবধায়ক সরকারই দরকার। কোন বিকল্প নেই? স্যার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন বিকল্প কেন দেখছেন না তাও ঠিক মাথায় আসছে না। দু-একটি বিকল্পের সন্ধান করব একটু পরে।


২য় যুক্তি প্রসঙ্গে
আসছি স্যারের ২য় যুক্তিতে-‘‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছে এবং একটি রাজনৈতিক ঐক্যের ফসল এটি’’। এ কথা সত্য যে, একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মুখে বর্তমান বিরোধী দল এ দাবিটি মেনে নেয়। ১৯৯৬ সালে ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে এটি আসে। কিন্তু যে কথা স্যার বলেন নি তা হলো, ১৯৯৬ সালের ব্যবস্থাটি ছিল বিএনপি-র তরফে একটি অনিচ্ছাকৃত ছাড় (reluctant concession)। জনদাবীর মুখে মানতে বাধ্য হলেও, এ ব্যবস্থাটিকে অকার্যকর করার সব চেষ্টাই তারা করেছে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে যতটা ক্ষমতাশালী করা যায় সেদিকেই ছিল তাদের নজর। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে জিম্মি। এ সরকার নীতি নির্ধারণ করতে পারবে না। এ সরকারের জবাবদিহিতা রাষ্ট্রপতির কাছে। স্পর্শকাতর সেনা নিয়ন্ত্রণও দলীয় রাষ্ট্রপতির হাতে। দেশে যুদ্ধাবস্থা হলে আগের সরকার ফেরত আসার এক প্যাঁচানো বিধানও রাখা হল। আব্দুর রহমান বিশ্বাস তাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করেন নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে দেখেই সেনাবাহিনীতে ঝামেলা লাগিয়ে দিয়েছেন। বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলছেন উনার করার কিছুই ছিল না। ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমান প্রথম রাতেই তাঁর পক্ষপাত পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন। ২০০১ সালের পর ৪ দলীয় জোটের পরবর্তী ৫ বছর তিনি নানা সরকারি সুযোগ সুবিধা ভোগ ছাড়াও বিদেশ ভ্রমণ করেছেন জোট সরকারের পক্ষে প্রচারণা চালাতে। ২০০৪ সালে দলীয় বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা বানাতে সংবিধান আরেকটু ঝালাই করে নেয় বিএনপি। ২০০৬ সালে তো প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে পুরো তত্ত্বাবধায়ক সরকারই ছিনতাই করে নেয়। মনে পড়ে সেদিন রাতে টেলিভিশন বোরহান স্যারকে দেখেছিলাম ঐ গুরুতর সংবিধান লংঘনের পক্ষে সাফাই গাইতে। এর মধ্যে এক উপদেষ্টার পরিবার তিন মাসের রাজত্বের গরমে দুর্নীতিতে মেতে উঠেন। এই ইয়াজউদ্দিনি প্রচেষ্টার সরাসরি ফসল ২০০৭ সালে সেনা শাসন। ঠিক এ কারণেই ২০০৭ সালের পর এডভোকেট সুলতানা কামাল বনাম বাংলাদেশ ( ১৪ এমএলআর, হাইকোর্ট বিভাগ, ১০৫) মামলায় আদালত বলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জনগণ রাষ্ট্রের মালিকানা হারিয়ে ফেলে। (রায়ের প্যারা ১৩৮ দেখুন)। স্যার গণতন্ত্র কোথায়?

৩য় যুক্তির জবাবে
স্যারের তৃতীয় যুক্তিটিও কিছুটা বিভ্রান্তিকর। বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তের ক্রমধারা সবসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে ছিল কথাটি আংশিক সত্য, পুরো সত্য নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে প্রথম চ্যালেঞ্জ করা হয় আনোয়ার হোসেন খান বনাম স্পিকার, জাতীয় সংসদ (৪৭ ডিএলআর ৪২) মামলায়। তখন এর দাবীতে বিরোধী দলের সংসদ বর্জন চলছে। বিএনপি সরকারি দল। এটর্নি জেনারেলও বিএনপির নিযুক্ত। বিচারপতি কাজী মনোয়ার উদ্দিন ও বিচারপতি কাজী সফি উদ্দিন আহমেদ এটর্নি জেনারেলের যুক্তি মেনে নিয়ে বলেন, সংবিধানের মৌলিক নীতিমালার চৌহদ্দির ভিতর এ ধরনের সরকারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল (রায়ের প্যারা ৩৬ দেখুন)।
১৯৯৬ সালে ১৩-তম সংশোধনীর পর এটাকে আবার চ্যালেঞ্জ করা হয় সৈয়দ মুহাম্মদ মশিউর রহমান বনাম বাংলাদেশ (১৯৯৭ বিএলডি ৫৫) মামলায়। এখানে অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। বরং ১৩ তম সংশোধনীর প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। প্রসঙ্গক্রমে বিচারক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেন। ১৯৯৯ সালে একে পূর্ণাঙ্গভাবে চ্যালেঞ্জ করা হয় এম সলিম উল্লাহ বনাম বাংলদেশ (৫৭ডিএলআর ১৭১) মামলায়, যেটির রায় আসে ২০০৪ সালে। বিচারপতি শাহ আবু নায়ীম মুহাম্মদ মমিনুর রহমানের বেঞ্চে মামলাটি আসলেও তাঁর অনুরোধে প্রধান বিচারপতি বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠান। কোর্ট তাঁর রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সাথে সংগতিপূর্ণ বলে রায় দেন। কিন্তু যে বিষয়টি বোরহান স্যার তাঁর লেখায় আনেন নি, তা হলো ঐ মামলায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উত্তর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে যে যুক্তি-তর্ক এসেছিলো সেটি। মামলায় আওয়ামী লীগের আইনজীবী ব্যরিস্টার আমিরুল ইসলাম ও এমিকাস কিউরি ব্যারিস্টার রফিকুল হক সতর্ক করেছিলেন যে সুপ্রীম কোর্টের বিচারকদের দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করবে এবং তাড়াতাড়ি এর বিকল্প খুঁজে নেওয়া দরকার (রায়ের প্যারা ১৯ দেখুন)। আদালতও তাঁর রায়ে বিষয়টি নিয়ে বিকল্প সন্ধানের পথ খোলা রাখেন (রায়ের প্যারা ৯৩ দেখুন)। পরবর্তীতে বিচার বিভাগ দলীয়করণে এ ব্যবস্থা কি নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে তা বোরহান স্যারের চেয়ে আমার বেশি জানার কথা নয়।
শুধু তাই নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নানা অসঙ্গতি উঠে আসে কমপক্ষে আরো ৪টি মামলায়-এডভোকেট সুলতানা কামাল বনাম বাংলাদেশ যেটি আগেই উল্লেখ করেছি, পীরজাদা সৈয়দ শরিয়ত উল্লাহ বনাম বাংলাদেশ (৬১ডিএলআর ৬৪৭), ইদ্রিসুর রহমান বনাম বাংলাদেশ (৬০ ডিএলআর ৭১৪) এবং মাসুদ আর চোবহান বনাম ইলেকশন কমিশন (২৮বিএলডি ৩১৭)। এ প্রেক্ষাপটে ২০১০ সালে মহামান্য আপীল বিভাগ ব্যবস্থাটিকে অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক বলে রায় দিয়ে হতবাক (utterly surprised) হয়ে যাওয়ার কোন কারণ আছে কি?
এমনকি আপীল বিভাগে মামলার শুনানিতে এমিকাস কিউরিদের অবস্থান প্রসঙ্গে বোরহান স্যারের মন্তব্যটিও বিভ্রান্তিকর। ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, বিচারপতি টি এইচ খান, মাহমুদুল ইসলাম এবং ড. কামাল হোসেন ব্যবস্থাটি রেখে দেয়ার প্রস্তাব করলেও বিচারকদের ব্যাপারে বিকল্প ভাবার পরামর্শও তাঁরা দেন (প্রথম আলো, ১ এপ্রিল ২০১১)। ব্যারিস্টার রফিকুল হক দেন সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠে। ড. এম জহির ব্যবস্থাটির পুরো সংশোধনের প্রস্তাব করেন (৩১মার্চ, ২০১১ প্রথম আলো)। ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি এটি বাতিলের পক্ষে মত দেন (১০মে, ২০১১ প্রথম আলো)। আর আপীল বিভাগ তো তা-ই করেছেন। গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে নীতিগতভাবে এটাকে অসাংবিধানিক বলেছেন। আবার আগামী দু’মেয়াদে ব্যবস্থাটি রাখার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন। সেক্ষেত্রে বিচারপতিদের এর সাথে না জড়িয়ে বিকল্প সন্ধানের দায় সংসদ তথা রাজনীতিবিদদের উপর দিয়েছেন। তাহলে, স্যারের হতবাক (utterly surprised) হয়ে যাওয়ার কারণ কি? আপীল বিভাগের মতের শেষের দুই অংশ থেকে এটা স্পষ্ট যে, ব্যবস্থাটির সংশোধন দরকার এবং তা করতে হতো রাজনীতিবিদদেরই। আমার মনে হয় রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতায় দায় বিচার বিভাগের উপর চাপানোর একটা প্রচেষ্টা এখানে কাজ করতে পারে। বিকল্প সন্ধান করতে হলে তো বিএনপিকে সংসদে যেতে হয়। তা তারা করবে কেন?
রায়ের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি নেতারা এক ভূতুড়ে বিকল্প হাজির করলেন (সংসদে নয়, সংবাদ সম্মেলনে)। অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করার বিধান বাদ দিয়ে সুপ্রীম কোর্টের মাধ্যমে সরকার পরিচালনা করা যেতে পারে! সম্ভবত বিচারপতিরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় দেখবেন। কেউ কেউ নির্বাচন কমিশন দেখবেন। সেক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রীর মত কিছু একটা হবেন। বিচার বিভাগ দলীয়করণে রাজনৈতিক দলগুলোর যেটুকু লাজ-লজ্জা বাকি আছে সেটুকুও যেত। আগে হিসাব হতো সর্বশেষ অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি আমার দলের কিনা-এবার হিসাব হতো গোটা সুপ্রীম কোর্ট আমার দলের কিনা। সরকারি দল আরেক পা এগিয়ে। ৩০ মে ২০১১ তারিখ জানিয়ে দিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারই থাকবে না। রাখতে চাইলে বিরোধী দলকে বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে আসতে হবে। ভাবলাম বিএনপি তাঁদের ভুতুড়ে প্রস্তাবটা আরেকটু ঘষামাজা করে নিয়ে আসবে। কিন্তু এবার তাঁরা সেই প্রস্তাবটাই বেমালুম ভুলে গেলেন। ৩১ মে আপোষহীন ঘোষণা এল -আলোচনার কোন সুযোগ নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে এখন যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে। ড. বোরহান স্যারও দেখলাম সেটিই চান। তাহলে আপীল বিভাগ অবৈধ ঘোষণা করলেন কোনটাকে? মজার ব্যাপার অন্যত্র। ৫ম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর সংবিধান নতুন করে ছাপানো হলে বলা হয় রায় অনুসারে ছাপানো বেআইনী। যা করার সংসদকে করতে হবে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হলে বলা হয় কোর্ট তো আগামী ২ নির্বাচন এর অধীনে করতে বলেছেন। অতএব সংসদ এটা এখন বাতিল করতে পারে না। তাছাড়া পূর্ণাঙ্গ রায়ও মেলেনি এখনো!


বিকল্পের সন্ধানে

এবার নির্বাচন কমিশনের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে আমরা আর কি কি করতে পারি তা দেখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আমাদের বিবেচ্য বিষয় মূলত তিনটি-(১) কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা (২) আর্থিক স্বাধীনতা এবং (৩) কার্যনির্বাহের স্বাধীনতা। সংবিধানের ১১৮(৩), (৪), (৫) এবং ১১৯(১) অনুচ্ছেদ স্পষ্টতই নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন পুরো সরকারি সচিবালয় হতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সম্পূর্ণ আলাদা করা হয়েছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০০৯ এর ৩(২) ও ১৪(১) ধারার মাধ্যমে। এর সাথে যোগ করে নিন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের একক কর্তৃত্ব রাষ্ট্রপতির (আসলে প্রধানমন্ত্রীর) হাত থেকে সুপ্রীম কোর্টের নেতৃত্বাধীন সার্চ কমিটির হাতে চলে যাওয়াটা।
নির্বাচন কমিশনের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ব্যাপারটাও খেয়াল করে হয়েছে সংবিধানের ৮৮ (খ), (গ) এবং ৯০(২) অনুচ্ছেদে। বলা হয়েছে নির্বাচন কমিশনের প্রশাসনিক ব্যয়গুলো রাষ্ট্রের এমন খরচ যেগুলোর ব্যাপারে সংসদের বাজেট অধিবেশনে পর্যন্ত কাট ছাঁট করার সুযোগ থাকবে না। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০০৯ এর ৮ এবং ১৬ ধারাও সে কথাই বলছে। তবে সমস্যা হতে পারে আইনটির ৭(১) ধারা নিয়ে। এখানে নির্বাচন কমিশনের আর্থিক প্রস্তাব বিবেচনা করার যে ক্ষমতা সরকারকে দেয়া হয়েছে তা কমিশনকে আর্থিকভাবে রাজনৈতিক সরকারের মুখাপেক্ষী করে রাখতে পারে।নির্বাচন কমিশনের কার্যনির্বাহের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে সংবিধানে ১২০ এবং ১২৬ অনুচ্ছেদ। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল যোগান দিতে বাধ্য এবং বিষয়টি তাঁর নিজস্ব বিবেচনার উপর নির্ভরশীল নয়। ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের ৫ ও ৫৩ ধারা এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০০৯ এর ১০ ধারাও এ উদ্দেশ্যে নিবেদিত। কিন্তু সমস্যা পেয়েছি নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে সরকারের অসহযোগিতায়। এক্ষেত্রে বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবটি আসলেই একটি মোক্ষম দাওয়াই। বিএনপি এদিকে নজর দেবে? মনে হয় না। তাহলে যে ক’টা হরতাল দেয়ার সুযোগ হয় না!

লেখক : প্রভাষক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

See Images of the Write Up from daily Shuprobhat as well






No comments:

Post a Comment

Amendment Rules, Politics and Debates in Bangladesh Dr M Jashim Ali Chowdhury in: Ngoc Son Bui and Mara Malagodi (eds), Asian Comparative Co...