Tuesday, September 3, 2024


‘বদলে না যাওয়া’ বাংলাদেশ

ড. এম জসিম আলী চৌধুরী
প্রভাষক, ইউনিভার্সিটি অব হাল, যুক্তরাজ্য

লেখাঃ ১৩ জুন ২০২৪
প্রকাশঃ দৈনিক আজকের পত্রিকা (৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪)
পত্রিকার লিংকঃ https://epaper.ajkerpatrika.com/textview/123671/1995161664.html 


১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সদ্য ভূমিষ্ঠ রাষ্ট্রের সরকার শপথ গ্রহণ করে এবং স্বাধীনতার সরকারি ঘোষণাপত্র (প্রকলেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স) প্রকাশ করে। ঘোষণাপত্রে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় গণতন্ত্র, জনগণের ক্ষমতায়ন ও আইনের শাসনের অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়। অঙ্গীকারটি কেবল কথার কথা ছিল না। এর পেছনে দেশের স্বাধীনতাকামী নেতৃত্বের গভীর সংকল্প ও সদিচ্ছা ছিল। দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনার স্বার্থে ওই সময় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা হলেও যুদ্ধ শেষ হওয়ার এক মাসের ভেতরেই তারা সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় ফেরত যায় (অন্তর্বর্তী সংবিধান আদেশ, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২)। রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা থেকে অধিকতর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যেতে আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা সময় নিতে পারতেন। নতুন দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সংবিধান প্রণয়নের জন্য অপেক্ষা করার অজুহাত দিতে পারতেন। ইচ্ছের সততায় (সিনসিয়ারিটি অব ইনটেনশন) তাঁরা সেটি করেননি। অন্তর্বর্তী সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সংসদীয় সরকারের চেতনা, আবহ ও কাঠামোর সুস্পষ্ট চিত্রায়ণ ছিল। এটিই ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে গৃহীত সংবিধানের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রকাঠামোটি মোটা দাগে এমন—ব্রিটিশ রাজার আদলে দেশের প্রতীকী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং জনগণের রায়ে নির্বাচিত ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভা নিয়ে দেশের নির্বাহী বিভাগ গঠিত (সংবিধানের চতুর্থ ভাগ)। জনগণের রায়ে নির্বাচিত জাতীয় সংসদকে দেওয়া হয়েছে আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের নিয়ন্ত্রণ এবং সরকারের প্রাত্যহিক ও চূড়ান্ত জবাবদিহির দায়িত্ব (সংবিধানের পঞ্চম ভাগ)। রাষ্ট্রীয় জীবনে সংবিধানের বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রের আইনকানুন প্রয়োগে সরকারের ক্ষমতা চর্চার লাগাম টানা, জনগণের মৌলিক অধিকার সুরক্ষা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দায়িত্ব পড়েছে বিচার বিভাগের ওপর (সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগ)। দেশের তৃণমূলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানের নির্বাহী বিভাগ অংশে উল্লেখ করা হলেও সেখানে কেন্দ্রের বা আমলাতন্ত্রের শাসনের বদলে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসনের নিশ্চয়তা দিতে আলাদা অধ্যায় যোগ করা হয়েছে (সংবিধানের চতুর্থ ভাগ, তৃতীয় অধ্যায়)।

সরকার, সংসদ ও আদালতের বাইরে একেবারে আলাদা একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে তুলে ধরা হয়েছে (সংবিধানের সপ্তম ভাগ)। সংবিধানের অষ্টম ভাগে আলাদা করে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রের মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়কে। সংবিধানের নবম ভাগে দেশের জনপ্রশাসনে কর্তব্যরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও মৌলিক কিছু সাংবিধানিক সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। আমলাদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারি কর্মকমিশনকেও আলাদা করে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে (নবম ভাগ, দ্বিতীয় অধ্যায়)। সংবিধানে সরকার, সংসদ ও আদালতের মতো বড় বড় তিনটি প্রতিষ্ঠানের পাশে এ চারটি তুলনামূলক ছোট প্রতিষ্ঠানকে এমন বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করাটা অর্থহীন কিছু নয়। সন্দেহ নেই, আমাদের স্বাধীনতার নায়করা দেশের তৃণমূল থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত গণতান্ত্রিক শাসন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধি বাছাই, রাষ্ট্রীয় তহবিলের জবাবদিহি এবং জনপ্রশাসন তথা আমলাতন্ত্রের রাজনীতি ও দলীয়করণমুক্ত থাকাকে এই পুরো কাঠামোর ভিত্তি বলে মেনেছেন।

সংবিধান প্রণয়নের ৫২ বছর পর পেছন ফিরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোটিকে দেখলে আমাদের কিছুটা বিষণ্ণতা গ্রাস করে। ৫০ বছরের এ যাত্রায় এ কাঠামোর অনেক বাঁকবদল ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। আমরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের সরকার, জাতীয় দলকেন্দ্রিক রাষ্ট্রপতির সরকার, সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রপতির সরকার, নির্বাচনকালীন অনির্বাচিত সরকার এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিযোগিতামূলকভাবে কর্তৃত্ববাদী সংসদীয় সরকারব্যবস্থার ভেতর দিয়ে গেছি। এত সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষে এসে দেখা যাচ্ছে, আমাদের স্বাধীনতার নায়করা যে রাষ্ট্রকাঠামো বাতলে গেছেন, সেটির কঙ্কালসার অবয়বটিই কেবল অবশিষ্ট আছে। কাঠামোটির অন্তর্গত চেতনা, লক্ষ্য ও আদর্শ হারিয়ে যেতে বসেছে।

মোটা দাগে রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সরকারগুলো প্রতিষ্ঠান বা সংবিধানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়ার চেয়ে ব্যক্তি বা দলীয় প্রধানকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। দেশের একাডেমিক মহলে একটি মৃদু সমালোচনা আছে যে সংবিধানপ্রণেতারা সংসদীয়ব্যবস্থার ভেতর সরকারপ্রধানের ক্ষমতা কিছুটা বেশি দিয়েছিলেন। গভীর বিবেচনায় এ সমালোচনাটিকে কিছুটা অপরিপক্ব বলে মনে হয়। ১৯৭০ সালের এক পাবলিক লেকচারে লর্ড হেইলসাম ব্রিটিশ ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থাকে ‘প্রধানমন্ত্রীর স্বৈরতন্ত্র’ আখ্যা দিয়েছিলেন। এ ব্যবস্থাটি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে স্বীকার করেই সাজানো। এখানে নিয়ন্ত্রণ আসে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ চাপ, সংসদের বিরোধী দল, শক্তিশালী ও স্বতন্ত্র স্থানীয় সরকার, স্বাধীন বিচার বিভাগ, শক্তিশালী গণমাধ্যম ও জবাবদিহি নিশ্চিতকারী অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। আমাদের মতো উপনিবেশ-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোতে জবাবদিহির এ ব্যবস্থাগুলো অনুপস্থিত থাকায় বা শক্তিশালী না হওয়ায় ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থার প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিকতাটিকে অতিরিক্ত চোখে পড়ে।





























বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় কখনো কখনো নির্বাচিত প্রতিনিধির শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা গেলেও সেটি সংহত, নিরবচ্ছিন্ন ও কার্যকর হওয়ার আলামত সুস্পষ্ট নয়। স্থানীয় সরকারে কেন্দ্রীয় সরকার ও মাঠপর্যায়ের আমলাতন্ত্রের হস্তক্ষেপ জোরালো। গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের হস্তক্ষেপপ্রবণতা। এতগুলো ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে অযাচিত হস্তক্ষেপ দেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে অনেকটাই জিম্মি করে ফেলেছে। আমলাতন্ত্রের রাজনীতি-নিরপেক্ষ পেশাদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠার মতো পরিবেশ, পরিস্থিতি বা এর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কখনোই দেখা যায়নি। স্বাধীন স্বতন্ত্র সরকারি কর্ম কমিশনও দৃশ্যমান হয়নি।

বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের আইনসভা সে অর্থে সরকারের জবাবদিহির জায়গা হয়ে উঠতে পারেনি। প্রায় সবাই এ জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদকে দায়ী করলেও সংসদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব-প্রতিপত্তি কেবল সংসদ সদস্যদের দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে না পারার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বলেই মনে হয়। আসল সমস্যাটি আমাদের রাজনৈতিক দলব্যবস্থার ভেতর থেকে আসে, যেখানে গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, তৃণমূলের পছন্দে দলের মনোনয়ন লাভ বা নেতৃত্বের স্থানে উঠে আসার সুযোগ অনুপস্থিত। ফলে সংসদ সদস্যের পক্ষে দলের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের বিরোধিতা করা বা সরকারের নীতির বিরোধিতা করা অনেকটাই রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল। ব্যাপারটি শুধু সংসদে ভোট দেওয়াতে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সংসদের প্রশ্নোত্তর, সংসদীয় বিতর্ক বা সংসদীয় কমিটির জবাবদিহিমূলক কর্মকাণ্ডের পুরোটাতেই প্রভাব ফেলে।

জনপ্রিয় ভাষ্যে দেশের বিচার বিভাগকে ‘জনগণের আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল’ বলা হলেও সামরিক শাসন এবং অনেক রাজনৈতিক সরকারের সময়ও বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগকে খুব বেশি নাড়া দিতে পারেনি। উচ্চ আদালতের নিয়োগপ্রক্রিয়ার অতি রাজনৈতিকীকরণের প্রবণতা প্রায়ই দৃশ্যমান ছিল। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৬ অনুচ্ছেদে সংবিধানপ্রণেতারা স্পষ্টভাবে অতিসত্বর নিম্ন আদালত পৃথক্‌করণের তাগিদ দিয়েছিলেন। অথচ কাজটি শুরু করতে আমাদের প্রায় ৩৫ বছর লেগেছে (২০০৭) এবং এর পরের ১৮ বছরেও আমরা কাজটি পুরোপুরি সমাধা করতে পারিনি।

সন্দেহ নেই যে আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং এতে জনগণের আস্থা ফেরার আশু কোনো লক্ষণ নেই। অনেকে এটার জন্য দলগুলোর আদর্শিক অবস্থানের চরম মেরুকরণ, এর ফলে সৃষ্ট প্রতিহিংসা ও ক্ষমতার রাজনীতিকে দায়ী করেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি এটাকে দলব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রহীনতার সমস্যা বলে মনে করি। আন্তদলীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া জারি থাকলে আন্তদলীয় প্রতিযোগিতা অনেকটাই গা-সওয়া হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ বা হারানোকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হতো।

মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়কে সংবিধানপ্রণেতারা যেভাবে একটি স্বতন্ত্র সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চেয়েছেন, সেটি আদতে হয়নি। এটি সরকার প্রশাসনের ভেতর একেবারে আত্তীকৃত হয়ে গেছে। আলাদা করে জনগণের চোখে পড়েনি। আমলাতন্ত্রের জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংসদের নিজস্ব ব্যবস্থা হিসেবে ন্যায়পাল নিয়োগের একটি বিধান (৭৭ অনুচ্ছেদ) সংবিধানপ্রণেতারা দিলেও সেটি এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। সময়ে সময়ে আইনের মাধ্যমে কিছু জবাবদিহির প্রতিষ্ঠান (যেমন দুর্নীতি দমন, মানবাধিকার, তথ্য ও নদী কমিশন) আমরা তৈরি করেছি বটে, কিন্তু সেগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে চেয়েছি—এমনটা দাবি করা কঠিন।

যুক্তরাজ্যের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির শিক্ষক ড. কুমারাসিঙ্গাম দক্ষিণ এশিয়ার সরকারব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁর পিএইচডি থিসিসে তিনি দাবি করেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যখন প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, তখন ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থাটি একধরনের ‘ইস্টমিনস্টার’ ব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়। কিছুটা হেঁয়ালি করে বলা যেতে পারে, আমাদের স্বাধীনতার নায়করা সম্ভবত একটি ‘ইস্টমিনস্টার’ ধাতে বেড়ে ওঠা সমাজকে একটি ‘ওয়েস্টমিনস্টার’ ধাঁচের রাষ্ট্রকাঠামো দিতে চেয়েছেন। ফলে বিগত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বৈষয়িক উন্নয়ন সূচকের অভাবনীয় বদল হলেও রাষ্ট্রকাঠামোর গোড়ার সংকটে তেমন বদল হয়নি। এ ক্ষেত্রে সম্ভবত আমরা অনেকটাই ‘বদলে না যাওয়া’ বাংলাদেশ।

Monday, September 2, 2024



সংস্কার লগ্ন (Reform Window)
ড এম জসিম আলী চৌধুরী
প্রভাষক, আইন, ইউনিভার্সিটি অব হল, যুক্তরাজ্য

২৪ অগাস্ট ২০২৪ (ফেসবুক পোষ্ট)



বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক সাহেব একজন দাম্ভিক মানুষ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। সেটা শুধু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নয়। চার দলীয় জোট সরকারের ২০০১-২০০৬ মেয়াদেও সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে তিনি ট্রাফিক পুলিশের সালাম দেয়া না দেয়া সহ নানাবিধ ছোটখাট ব্যাপারে অতিরিক্ত একগুঁয়েমি দেখানো, অ-বিচারক সুলভ ও অশোভন আচার-আচরণ করেছেন। উনার আচরণ, কথাবার্তা এবং চলন-বলনের ভেতর প্রজ্ঞা, ধৈর্য, ভিন্নমত ধারণকারীকে প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়ার প্রবণতা বা এমনকি সমালোচকেরও শ্রদ্ধা অর্জনের মতো কোন কিছু চোখে পড়তো না। নিজের পেশাগত ও সামাজিক অবস্থানের তোয়াক্কা না করে তিনি আচরণ করতেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর একেবারে মাঠ পর্যায়ের গুন্ডাপান্ডা টাইপের লোকদের মতো করে।

সংবিধান নিয়ে পড়ালেখা করতে গিয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের দেয়া বিভিন্ন রায়গুলোতেও জুরিসপ্রুডেন্সিয়াল কোন ডেপথ আমি কখনো পাই নি (সেটি এমনিতেও আমাদের খুব বেশি রায়ে পাওয়া যায় না)। উনাকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে কোথাও রেফারও করি না।

তারপরও দুঃখ লাগছে, গ্রেফতার হওয়ার সময় হতে উনার সাথে আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আচরণ সহ আদালত প্রাঙ্গণে উনার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দেখে। গতকাল গ্রেফতার হওয়ার পর, উনার দুর্দশা ও লাঞ্ছনাকে অনেকেই "ন্যাচারাল জাস্টিস" বলছেন। হয়তো হতেও পারে। আল্লাহ্‌র বিচার নিয়ে আমি বান্দার বুঝ ব্যবস্থা সীমিত। এই "ন্যাচারাল জাস্টিস" থেকে কোন শিক্ষা হয়তো ক্ষমতার বলয়ে আসা-যাওয়া করতে থাকা মানুষরা কেউ নিতে পারেন (যদিও এমন শিক্ষা আমি আজ পর্যন্ত কাউকে নিতে দেখি নি)।


দুনিয়ার আদালতে আমরা যদি উনার সাথে উনার মতোই আচরণ করি, তাহলে উনার সাথে আমাদের পার্থক্য কি হল? উনাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়েছে বলে ধরে নিচ্ছি, আচরণগত ও রাজনৈতিক মতাদর্শ জনিত নিন্দাবাদ ছাড়া, উনার বিরুদ্ধে ঠিক কি ধরনের ফৌজদারি বা দেওয়ানি অভিযোগ আনা হবে সেটি এখনো চূড়ান্ত হয় নি। রাষ্ট্রের কাছে একজন দাগী অপরাধীরও নুন্যতম প্রাপ্য কিছু থাকে। অতীতের কর্দমাক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ভেঙ্গে চুরে প্রত্যাশিত বা প্রতিশ্রুত নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি আসলেই আমরা গড়তে চাই তাহলে এই 'আপাতত আগেরগুলোর শোধ তুলে নিই, সংস্কার পরে দেখা যাবে" মানসিকতাটা কোন শুভ সংকেত দেয় না।

হয়ত কেউ কেউ ভাবতে পারেন, রাজনৈতিক ভাবাদর্শে আমি আওয়ামী লীগ ঘরানার লোক বলে শুধুমাত্র শামসুদ্দিন মানিক সাহেবেরটা বেশি করে দেখছি। ব্যাপারটা আসলেই তেমনটি না। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নিয়ে আমার প্রকাশিতব্য বইটিতে আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি কিভাবে, কেন এবং কোন মানসিক ও সামাজিক ব্যধির চক্রে পড়ে আমাদের ৫৩ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে আসা পাঁচ-পাঁচটি সংস্কার লগ্ন (Reform Window) ব্যর্থ হয়ে গেছে এবং আমরা ঘুরে ফিরে সেই আগের পাক-চক্রে পড়ে থেকেছি। আমার বইয়ে আলোচিত পাঁচটি সংস্কার লগ্ন হচ্ছে - ১৯৭২ এ স্বাধীন দেশের যাত্রা শুরুর মুহূর্ত, ১৯৭৫ এর মধ্য অগাস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরের মুহূর্ত, ১৯৯০ এর গণ অভ্যুত্থান এর পর গণতন্ত্রের পথে নবযাত্রার মুহূর্ত, ২০০৭ এর ১/১১র পর মাইনাস টু ফর্মুলায় দুর্নীতিমুক্ত নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির আশা দেয়ার মুহূর্ত, এবং ২০০৯ এ ভুমিধ্বস বিজয় নিয়ে আওয়ামী লীগের নতুন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের মুহূর্ত।

দুঃখজনকভাবে প্রতিটি বাঁক বদলের মুহূর্তই চরম ব্যর্থতায় কালের গর্ভে হারিয়েছে। আশা করি ও দোয়া করি - এই ষষ্ট মুহূর্তটিও কালের গর্ভে না হারাক।


সংশোধন, সংস্কার বা "নতুন সংবিধান" এর "একিলিস হিল"

ড এম জসিম আলী চৌধুরী
প্রভাষক, আইন, ইউনিভার্সিটি অব হল, যুক্তরাজ্য



আমাদের নতুন শাসকরা "রাষ্ট্র সংস্কার"র এক সুদূর প্রসারী কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছেন। তাঁদের মৌলিক এজেন্ডায় সন্দেহাতীতভাবে সংবিধান থাকবে। তাঁরা এটা নিয়ে কতদূর যাবেন সেটিই সম্ভবত এখন হিসেব নিকেশ হচ্ছে। এ ধরণের উচ্চভিলাষী কর্মযজ্ঞের একটা "একিলিস হিল" আছে।

আমাদের নব্বই পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যক্তি বদল করে এবং নির্বাচনী কিছু আইন সংশোধন করে তাঁদের সংস্কার কর্মসূচী শেষ করতেন। তারপর একটা নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিতেন। তাদের তুলনায় ২০০৭-০৮ এর "তত্ত্বাবধায়ক সরকার" (আমি অবশ্য এটাকে সংবিধান বহির্ভুত সেনা সমর্থিত সরকার বলতে স্বচ্ছন্দ) বেশ আগ্রাসী ছিলেন। "দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা" ও "মাইনাস টু" রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জিগির তুলে তারা দেশের আইন কানুনেও বেশ অনেকটা সংশোধন করেছিলেন। মঈন উদ্দিন আহমেদ সাহেব রাখঢাক না রেখেই "মেধাবী ও তরুণ প্রজম্ম"কে দিয়ে একটা "জাতীয় সাংবিধানিক কনভেনশন" করে সংবিধান নতুন করে লেখার কথা বলেছিলেন। তিনি স্পস্টভাবেই জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সাহেবের মতো করে রাজনৈতিক দল গঠনের কাজকর্ম শুরু করেছিলেন। হালে পানি পাওয়ার আশায় ভারত সফরেও গিয়েছিলেন। আমেরিকা ও ইইউ ব্লকের যারা ১/১১-র স্পন্সর ছিলেন তাদের পূর্ণ সমর্থন পান নি বলে হয়তো শেষমেশ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

সন্দেহ নেই আমাদের বর্তমান সরকারটি ১৯৯০ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর মত নয়। ১/১১ এর মতো সংবিধান বহির্ভুত হলেও, এটি ওই সেনা সমর্থিত সরকারের চেয়ে অনেক বেশী জনগণ সংশ্লিষ্ট এবং এই সরকারের ম্যান্ডেট অনেক বেশি শক্তিশালী। তারপরও এর "সংস্কার এজেন্ডা"র সবচেয়ে বড় সংকটটি - যেটিকে আমি এর "একিলিস হিল" বলতে চাই - সেটি তুলে ধরা বাঞ্চনীয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিপদজনক প্রশ্ন হচ্ছে - কাদের ইচ্ছায়, কাদের আদর্শিক অবস্থানকে প্রায়োরিটি দিয়ে সংস্কার হবে। সংস্কারের এজেন্ডা কি হবে, কোথায় সংস্কার হবে এবং কারা এই সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশীজন হবেন। বিশেষত সমাজের সব মত-পথের মানুষকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংষ্কার না হলে দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো সংস্কারও মুখ থুবড়ে পরে। সমস্যা হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়াটা সবসময় সহজ কাজ নয়। যেমন ধরুন এখনকার বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের অংশ নেয়া তো দূরের কথা, ছায়া মাড়ানোর কথা বলাও বিপদজনক। "জনগণ" "পরাজিত"দের মুখ দেখতেই চায় না। যে কোন রাজনৈতিক বিপ্লবের পর যারা হেরে গেছেন তাদের সাথে কথা বলার চিন্তা করাও অকল্পনীয়। এটি জনতুষ্টিবাদী গণতন্ত্র (Populist Democracy)-র একটি "একিলিস হিল"।

এটি "একিলিস হিল" কারণ এ আপদ চাইলেই মুছে ফেলা যায় না। একে মেনে নিয়েই কাজ সারতে হয়। একে ইগনোর করে বিজয়ীরা হয়ত তাৎক্ষণিক জেতেন। তবে দূরের কোন একদিন আবার ওই আপদ মাথা ছাড়া দিয়ে উঠে। "জনগণ"ও ততোদিনে "জয়ী"দের থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকাতে শুরু করে। পেছন দিকে তাকানোর কথাটা এই মুহূর্তে আমাদের অনেকেরই বিশ্বাস হবে না। তারপরও মনে করা যেতে পারে ১৯৭২ সালের জানুয়ারীর কথা।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেন। অন্তর্বর্তী সংবিধান দিলেন। সে অনুযায়ী ১৯৭২ এর ডিসেম্বরে একটা সংবিধান হলো। সংবিধান প্রণয়ন, এর উপর জন মত যাচাই, সংশোধন প্রস্তাব আহবান ও বিবেচনা, দেশী বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ-সালাপ সবই হলো। সংবিধান প্রণীত হয়ে যাওয়ায় পর রাশিয়া ও চীন ঘেঁষা বাম রাজনৈতিক দল এবং আমেরিকা ঘেঁষা প্ৰধান বিরোধী দল (জাসদ) সহ সর্বস্তরের বিরোধী দলের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া এলো। মস্কো পন্থী বাম-রা সমর্থন দিলেন। চীনপন্থী বাম-রা ১৯৭০ এর নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগ নেতাদের স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণনয়নের অধিকার বা ম্যান্ডেট আছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন। বললেন, ১৯৭০ এর বিজয় এক জিনিস আর ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়ণ আরেক জিনিস (তেমন প্রশ্ন এখন যারা ছাত্র আন্দোলনের ফলে ক্ষমতায় এসেছেন তাঁরাও ফেস করতে পারেন)। জাসদের পক্ষ থেকে সংবিধানটিকে "বৈজ্ঞানিকভাবে সমাজতান্ত্রিক নয়" বলে সমালোচনা করা হলো এবং বলা হলো, তাঁরা ক্ষমতায় আসলে এটি ছুঁড়ে ফেলে দেবেন।

এবার দেখুন ১৯৭২ এর সংবিধানের "একিলিস হিল"টা কোথায়। পুরো সংবিধান প্রনণয় ও এর সমালোচনা পক্রিয়ায় মুসলিম লীগ (১৯৭১ এর আগে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্ধী), জামায়াত ইসলামী, নেজামে ইসলামীসহ ইসলামপন্থী দলগুলোর যে বিশাল সামাজিক অবস্থান ও সমর্থক গোষ্টি দেশে রয়ে গেছে তাদের কোন পালস, অনুভূতি, বক্তব্য বা প্রতিক্রিয়া শোনার, জানার বা চিন্তায় নেয়ার গরজ কারো পড়ে নি। কারণ তারা তখন বিপ্লবের "পরাজিত পক্ষ"। আজকের মতো সেদিনও "জনগণ" ও তাঁদের নেতারা "পরাজিত"দের মুখ দেখা তো দূরের কথা, ছায়া মাড়াতেও রাজী ছিলেন না। বাস্তবতা হচ্ছে, আপনি কাউকে না দেখলেই তারা অস্তিত্বহীন হয়ে যায় না। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ এ জাসদ না, ইসলাম পন্থী দলগুলোর সমর্থনপুষ্ঠ গোষ্ঠীরাই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন এবং ১৯৭২ এর সংবিধানের খোল নলচে পাল্টে দেন। আমাদের মতো ডিভাইডেড সোসাইটিতে এটিই যে কোন বিপ্লবের, সংস্কারের বা সংবিধানের "একিলিস হিল"। দুই বছর আগে, ২০২২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবস উপলক্ষে ইংরেজি দৈনিক "দ্য ডেইলি স্টার" এ আমি লিখেছিলাম (লিংক প্রথম কমেন্টে) -

"[T}he total exclusion of the religious-conservative political elements from the constitution-making process (how logical it appeared in 1972) had reduced (if not dislodged) the Constitution's political morale. In 1972, an essential requirement of the parliamentary system – conservative-liberal bipartisanship, was conspicuously missing. The conservative political elements of undivided Pakistan - the Muslim League (ML) and Jamaat-e-Islami (JI), actively opposed the liberation of Bangladesh. They lost their right to exist in the newly independent country, but the pro-Soviet leftists could not fill the vacuum with their insignificant mass base in society. So, the seismic political change of 1975 led to a quick resurgence of the radical right. From that point onwards, Bangladesh's constitutional unmaking has been rapid. Avenging their exclusion from the constitution-making process, the religious nationalists would actively deconstruct the Constitution and its foundational pillars."



[শেষ কথা: অনেকেই হয়তো ভাবছেন আমি ইনিয়ে বিনিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে সংলাপ করতে বলছি। না। আমার ঘাড়ে দুইটা মাথা নেই।আওয়ামী লীগ নিজেই এখন কোথাও বসার মতো অবস্থায় নেই (যেমনটি ১৯৭২ এ মুসলিম লীগ, জামায়াত ইসলামী ছিলো না)। আমি বলছি বর্তমান সংস্কার প্রক্রিয়াটিকে যতদূর সম্ভব রাজনৈতিক রাখার কথা। সংবিধান সংশোধন বা নতুন সংবিধান প্রনণয়নের কাজটি নির্বাচনের পর জয়ী সরকারী ও বিরোধী দলের হাতে ছেড়ে দিলেই হয়তো তারা বর্তমানের "বিপ্লবী উত্তেজনার" ক্ষণটা পেছনে ফেলে ঠান্ডা মাথায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দিকে যেতে পারবেন। আগামীর সরকারি দল ছাত্রদের নব গঠিত কোন রাজনৈতিক দল, বিএনপি বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল যে-ই হোক, তাঁরা যে পুরো অন্তর্ভুক্তিমূলক হবেন সেটা নিশ্চিত নই (যেমন ২০১১ সালে ১৫-তম সংশোধনীর সময় সে রকম একটা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা গোঁয়ার্তুমি করেছেন)। তবে তাঁদের একিলিস হিল-টা হয়ত বর্তমানের অরাজনৈতিক সরকারের চেয়ে কম হবে। বিপ্লব ভালো। তবে প্রতিটি বিপ্লবের উত্তেজনার ভেতরেই এর ধ্বংসের বীজ লুকিয়ে থাকে।]

ডেইলি স্টারের লেখাটির লিংক: Constitution-making and unmaking in Bangladesh | The Daily Star

‘বদলে না যাওয়া’ বাংলাদেশ ড. এম জসিম আলী চৌধুরী প্রভাষক, ইউনিভার্সিটি অব হাল, যুক্তরাজ্য লেখাঃ ১৩ জুন ২০২৪ প্রকাশঃ দৈনিক আজকের পত্রিকা (৩ সেপ...